শিক্ষার সংস্কারে করণীয় অনেক। নতুন সরকার তার উদ্যোগ
শুরু করেছে। উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজেছেন মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় |
পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে তথ্যকার্পণ্য যে একটা বৈশিষ্ট্য, সেটা কমবেশি সবাইকেই টের পেতে হয়। যে রাজ্যে অতি সাধারণ একটা সরকারি নির্দেশনামা রাজ্য স্তর থেকে গ্রামে পৌঁছতে বছরখানেক লেগে যায়, সেখানে তথ্যের অধিকার আইন প্রয়োগের দুর্দশা নিয়ে কেউ বড় একটা অবাক হয় না। কিন্তু সে কারণেই একটু আশ্চর্যই হতে হচ্ছে রাজ্যের একটি দফতর বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরকে খুব তড়িঘড়ি করেই নানান তথ্য সাধারণের নাগালে আনার একটা ব্যবস্থা করতে দেখে। নানান সরকারি আদেশ ও বিভিন্ন প্রতিবেদন ঝটিতি তুলে দেওয়া হচ্ছে দফতরের ওয়েবসাইটে। এটা ঠিক যে, ইন্টারনেট খুব কম লোকের কাছেই ব্যবহারসুলভ। কিন্তু যত কমই হোক, অন্তত কিছু মানুষ যে এর মাধ্যমে বিদ্যালয় শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পেতে পারছেন, এটা একটা বড় ব্যাপার, সে কথা মানতেই হবে।
সম্প্রতি দেখার সুযোগ হল, দফতরের নিযুক্ত সিলেবাস কমিটির রিপোর্ট, যা পড়ে আরও আশ্চর্য হলাম। রিপোর্টে এত নতুন জিনিসের কথা বলা আছে, যার প্রয়োগে এই অভাগা রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শিশু মৌলিক শিক্ষার আইনের একটা বড় সুযোগ পেতে পারে। অথচ সমাজে কিন্তু শোরগোল পাশ-ফেল রাখা বা তুলে দেওয়া নিয়ে। বিশেষজ্ঞ কমিটি শিক্ষার অধিকার আইনকে সামনে রেখেই তাঁদের মূল্যবান প্রস্তাবগুলি পেশ করেছেন। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের সামাজিক অবস্থান, তাদের চাহিদা, তাদের ভাল-লাগা এ সমস্তের কথাই ভাবা হয়েছে। নম্বর তোলার প্রতিযোগিতা থেকে মুক্তি দিতে দলগত পঠনপাঠনের উপর জোর দেওয়া, পাঠ্য বিষয়ে তথ্যের ভার কমিয়ে ধারণা তৈরির উপর জোর দেওয়া, মূল্যায়ন পদ্ধতিকে সার্বিক ও নিরবচ্ছিন্ন করার মতো শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাভাবনার কথা এখানে বলা হয়েছে। গুরুত্ব পেয়েছে শিক্ষকের দায়বদ্ধতা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ। শারীর শিক্ষা, কর্মশিক্ষা, শিল্পশিক্ষা যেগুলির গুরুত্ব কম বলে ধরা হয়ে থাকে, সেগুলিকেও মর্যাদা সহকারে রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পরিকাঠামোগত উন্নয়নের দিকটা তো আছেই।
কোনও কোনও প্রস্তাব বিতর্কিত হতেই পারে, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে নতুন করে ইতিবাচক ভাবনার একটি দিক নির্দেশ আছে, ওয়েবসাইটে যে বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর ব্যবস্থা আছে। শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর অনুকূল ও সর্বজনীন করে তোলার একটি প্রয়াস আছে এই রিপোর্টে। পাঠ্যবই রচনা, বিশেষ করে সিলেবাসের ভার কমানোর উদ্যোগ এই কারণেই প্রশংসনীয় যে, সিলেবাস শিক্ষার্থীর চাহিদা ও সক্ষমতা উপযোগী হলে সেখানে পাশ-ফেলের প্রসঙ্গটাই গৌণ হয়ে পড়ে। কেন শিক্ষা প্রাইভেট টিউশন ও নোট-নির্ভর, আশা করা যায় এই বিশেষজ্ঞ কমিটি সে রোগ ধরেছে। দুনিয়া জুড়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু বই-নির্ভর না হয়ে শিক্ষণসামগ্রী তথা শিক্ষার্থীর নিজস্ব অভিজ্ঞতার মেলবন্ধনে জ্ঞান নির্মাণের যে দিশা, কমিটি সেই দিকনির্দেশই করেছে। শিশু যেখানে শেখার প্রক্রিয়ার সক্রিয় অংশীদার। শিক্ষকদের এক অংশ অবশ্য মনে করছেন, এই উদ্যোগের ফলে তাঁদের প্রভাব খর্বিত হবে। এক জন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, তাঁরা যদি তাঁদের মনটাকে একটু বদলে নেন, তা হলেই সমস্যা মেটে।
সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় যে-কোনও নতুন ভাবনা আনতে গেলেই পরিকাঠামোর দৈন্য সামনে এসে যায়। শিক্ষার অধিকার আইন সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট দায়বদ্ধতা জানায়। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৩৫:১ হওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষ, শৌচালয়, জলের ব্যবস্থা, গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ, শিখন সামগ্রী, সমস্তই এর মধ্যে আসে। নতুন ভাবনায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কথাও বলা আছে। বলা হয়েছে পরিচালন সমিতির পুনর্গঠনের কথাও, যেখানে অর্ধেক সদস্য হবেন মহিলা।
কোনও কোনও সুপারিশে স্ববিরোধিতা আছে বলে মনে হয়। যেমন নৈতিক মান উন্নয়নের তাগিদে বিদ্যালয়ে ব্রতচারী চালু করা, রবীন্দ্রসংগীত প্রবর্তনের ঝোঁক। ব্রতচারী বা রবীন্দ্রসংগীত উভয়েরই গুরুত্ব যথেষ্ট, কিন্তু রাজ্যের জনগোষ্ঠীর যে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, সেখানে কোনও বিশেষ ঘরানা চাপিয়ে দিতে গেলে শিক্ষাকে সর্বজনীন করার মৌলিক ভাবনাকে খর্ব করা হবে। এ নিয়ে আলোচনা দরকার। রাজ্য সরকার রিপোর্টের সারাংশ সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপিত করতে পারে।
আসল প্রশ্নটা থেকেই যায়। শিক্ষার অধিকার আইন লাগু হয়ে বছর ঘুরে গেছে, এ পর্যন্ত আইনের রূপায়ণে কোনও নির্দেশিকা (স্টেট রুল, যেটা আইন রূপায়ণে অপরিহার্য) তৈরি করা হয়নি। ফলে ভর্তি নিয়ে, পরিকাঠামো নিয়ে, পাশ-ফেল নিয়ে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। মিড-ডে মিলের মতো একটি প্রমাণিত ভাবে অত্যাবশ্যক প্রকল্পের সুষ্ঠু রূপায়ণের ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলি চলে আসছে, সেগুলির সহজেই সমাধান করা যায়, কিন্তু তা নিয়েও আমলাতান্ত্রিক গড়িমসি গেল না। শিক্ষার ভার শিক্ষা দফতরের পাশাপাশি পঞ্চায়েতের হাতেও আছে (শিশু শিক্ষা কেন্দ্র ও মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র), সেগুলির ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তাভাবনা নেই। অঙ্গনওয়াড়ির সঙ্গে শিক্ষা দফতরের কোনও যোগাযোগ নেই, যেটি কিন্তু প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
জনসাধারণের বৃহৎ অংশ যার মধ্যে আছে তথাকথিত পিছিয়ে পড়া শিশু, স্কুলছুট, বালিকা শিশু, শিশু শ্রমিক শিক্ষার আঙিনায় আসার জন্য তাদের সামনে চিরাচরিত যে বৃহৎ বাধাগুলি পথ আটকে আছে, সরকার ও সমাজ কি সেগুলি অপসারণে উদ্যোগী হবে? |