|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
|
হারিয়েই ফেলব?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্বন্ধে গভীর ভাবে ভাববার সময় হয়েছে।
এরাই তো প্রথম সোপান। বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তখনই তৈরি হবে, যখন
প্রতিষ্ঠানের প্রথম ইট মজবুত হয়। এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন
বিকাশ সিংহ |
|
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বিশ্বের মাপকাঠিতে প্রথম সারির হবে, এই একটা স্লোগান ইদানীং চালু হয়েছে। দুঃখের তিমিরে আশার আলো এই স্লোগানটি। শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু বাস্তব এবং বচনে অনেক ফারাক। বলা সোজা, করা কঠিন।
এত দিনের অসহ্য অবহেলা, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি, আর তার সঙ্গে নোংরা রাজনীতির ঘুষোঘুষি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ বিদ্যালয়। শিক্ষা জগতের শেষ সোপান বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই নিদারুণ করুণ পরিবেশে কোনও রকমে টিকে আছে। বিশ্বমানের পড়াশোনা করার কারও কোনও স্পৃহা বা উদ্যম নেই, শিশুরও মান সেই মাপের। বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী ভাল করছে এখনও, নিজেদের অধ্যাবসায় ও মেধার জোরে। বাঙালি সমাজের এই এক বিচিত্র এবং করুণ বৈশিষ্ট্য।
এই বাংলাতেই অতীতের নাম করা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বিশ্বমানের করব বলে আমরা মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। কোনও মানই নেই যেখানে, সেখান থেকে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একেবারে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া যায় না রাতারাতি। ধরা যাক, ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ কিংবা অক্সফোর্ড দীর্ঘ আটশো বছর ধরে শুধু বিশ্বমানের শিক্ষাক্ষেত্রই নয়, মৌলিক গবেষণার অতুলনীয় ভাণ্ডার। আজকের নয়, কম করে পাঁচশো বছর ধরে। এ সব আমরা
সকলেই জানি, কিন্তু সত্যটা হজম করতে আমাদের বড় আপত্তি।
ঘটনা হল, ধীরে পরিবর্তনের ধারাকে নিয়ে আসতে হবে, তার জন্য দরকার গভীর অধ্যবসায় এবং অসীম ধৈর্য। মূল ব্যাপার মানসিকতা, সামাজিক কাঠামো, বিশেষত দৃষ্টিভঙ্গির আপাদমস্তক পরিবর্তনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বড় আকারের সামাজিক আন্দোলন চাই, আর সেই আন্দোলন হবে পরিবর্তনের ঢেউয়ের ওপর চেপে।
|
প্রথম আলো |
অনেকেই, হয়তো নিজেদের অজান্তেই, ভেবে থাকেন যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। তা তো একেবারেই নয়। সমাজই ওই ছাত্রছাত্রীদের জন্মস্থান। কাজেই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বা কাঠামো দিয়েই ছাত্রছাত্রীরা তৈরি হচ্ছে। সমাজ যদি উচ্ছৃঙ্খল হয়, অশিক্ষিত হয়, গুন্ডামিকে প্রশ্রয় দেয়, ছাত্রছাত্রীও ওই দিকেই ছুটবে। কিন্তু বিদ্যালয়ে যে পড়ুয়ারা আসছে, তাদের প্রথম জীবনের শিক্ষার প্রদীপ জ্বলছে কোথায়? জীবনের প্রথম আলো কোথায় ফুটছে? বালকের স্বপ্নভঙ্গ কখন হল? কৃষ্টির প্রথম পরিচিতি সে কোথায় পেল? জীবনযুদ্ধের দামামা সে কখন শুনল? যৌবনের হাতছানি আর অদ্যম উৎসাহের যে রসায়ন, তার স্বাদ সে কোথায় পেল?
ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম দিনগুলিতে, আর তার পরে একটু ঘনপাক হয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাসঘরে। কোটি কোটি ছাত্রছাত্রী আট ক্লাস পর্যন্ত কোনও রকমে টিকে থাকে। বেশির ভাগই অভাবের তাড়নায় বিদ্যালয়কে বিদায় জানিয়েই যে ভাবে হোক দু’পয়সা রোজগার করতে মাঠে নামে। জানবার বা আবিষ্কার করার যে আগ্রহ, সে স্বপ্ন কিছু দিন পরেই চিরকালের মতো উবে যায়, নেহাতই সামান্য বাষ্পের মতন। এই বুকফাটা কাহিনি ভারতের শহরে অতটা নয়, কিন্তু বিশেষত এই দেশের অগণিত গাঁ-গঞ্জের রোজকার কাহিনি। |
|
আগামী ভারতবর্ষ তৈরি হচ্ছে ওই গাঁ-গঞ্জের ছেলেমেয়েদের নিয়েই। শহুরে ছেলেমেয়েরা ইদানীং অন্য ধরনের রঙিন কাজেই ব্যস্ত। একটি উদাহরণ দিই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। কয়েক মাস আগে আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের পীড়াপীড়িতে আমরা কয়েক জন ঠিক করলুম, কোচবিহারের বিখ্যাত জেনকিন্স বিদ্যালয়ে যাব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের ‘ইনস্পায়ার’ প্রকল্পের খাতিরে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে সুইটজারল্যান্ডের জগৎবিখ্যাত গবেষণাগার সার্ন-এ কী কাজ হচ্ছে এবং তার তাৎপর্যই বা কী, সোজা-সরল ভাষায় স্কুলের পড়ুয়াদের বুঝিয়ে দেওয়া, এই হল মূল উদ্দেশ্য। কোচবিহার একটি উদাহরণমাত্র। বহু জায়গাতেই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে।
কোচবিহারে যাওয়া খুব একটা সামান্য ব্যাপার নয়, প্লেন এখনও চালু হয়নি। বাগডোগরা থেকে রাস্তাটি অনেকটা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতন, জল নেই অবশ্যই, বলা যেতে পারে শুকনো ঢেউ। যে রাস্তা অনায়াসে দু’ঘণ্টায় সারা যায়, লাগল প্রায় পাঁচ ঘণ্টার কাছাকাছি। পরের দিন আমাদের বক্তৃতা, কোচবিহারের টাউন হলে। একটু দেরি হলেও গোটা হল ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে গিজগিজ করছে। মাস্টারমশাইদের পাত্তা নেই। আর পাত্তা থাকলেও নেহাতই নেপথ্যে, সময়টা হয়তো বেশি সকাল সকাল হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য! আমার ছাত্রটি অবশ্য ওখানকার কলেজের অধ্যাপক, তার বিপুল উৎসাহ।
|
দিন ফুরোয়, প্রশ্ন ফুরোয় না |
সার্ন-এর গবেষণাগার থেকে কোচবিহার কেবল দূরত্বই বড় কথা নয়, ব্যাপারটা ছাত্রদের কাছে এক অভাবনীয় স্বপ্নের জগৎ। বিশেষত যখন তারা মন দিয়ে শুনল যে এই ভারত থেকেই ওদের চেয়ে একটু বয়স্ক ছাত্ররা সার্ন-এ কাজ করতে যাচ্ছে ভারতের হয়ে। বক্তৃতার সময় লক্ষ করলুম কত ছাত্র কিন্তু একেবারে নিস্তব্ধ, কোনও ফিসফাস নেই, হট্টগোল তো একেবারেই নেই।
সব থেকে মনে ধরেছিল, সব বক্তৃতা শেষ হয়ে যাবার পরে ছাত্রদের প্রশ্ন করার সময় এল যখন। তীক্ষ্ন ধারালো প্রশ্ন, একটার পর একটা। কতকগুলি প্রশ্ন গভীর, অনেক চিন্তা ও ভাবনা থেকেই তাদের প্রশ্ন। বোঝাই গেল, ওই ক’টি ছাত্র পদার্থবিদ্যার গভীরে পৌঁছে গেছে। ধীরে ধীরে বেলা গড়িয়ে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই-ছুঁই। তখনও চলেছে প্রশ্নবাণ। জিজ্ঞেস করলুম, খিদে পাচ্ছে না? উত্তর এল মোটামুটি এই রকম: ‘রোজই তো খাই, আজকের খাওয়া অন্য রকম।’
|
পাপক্ষয় |
এই হিরের টুকরো ছেলেমেয়েরা সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, পল্লিগ্রাম আর মফস্সলের কোণে কোণে। বড় হয়ে তারা কোথায় যায়? বেশির ভাগই অভাবের তাড়নায় যে-কোনও চাকরি নিয়ে চারটি ভাত জোগাড়ে বাজারে নামতে বাধ্য হয়, বাকি এই শহরের জঙ্গলে হারিয়ে যায়।
মাস্টাররা সময় মতো আসেন না, গতানুগতিক ক্লাস নিয়ে পুরনো বিষয়বস্তু নাড়াচাড়া করে রেখে দেন। মাসের শেষে একটি চেক, এ থেকেই শুরু, এতেই শেষ। টিউটোরিয়ালের দিকে বেশি নজর। নগদ পয়সা না! লেকচারে কোনও উদ্যমও নেই, উত্তেজনা নেই। দিনগত পাপক্ষয়।
আমরা দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিক যোজনা নিয়ে আলোচনা করছি। বড় বড় গবেষণাগার বানাব, বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় বানাব, এন আই টি খুলব। বাস্তবিকই আনন্দের কথা। কিন্তু এই যে কোটি কোটি ছাত্র আট ক্লাস পর্যন্ত কোনও রকম করে উঠে বিলুপ্তির তমসায় ডুবে গেছে, তাদের কথা কি আমরা ভাবি না? এই যে বিরাট জ্ঞানের আধার, তাদের ভুলে যাব?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার সম্বন্ধে আমাদের গভীর ভাবে ভাববার সময় হয়েছে। এরাই তো ভারতকে গড়বে, এরাই তো শিক্ষার প্রথম সোপান। আমরা কেন অবহেলা করি, ফ্যাশনেবল নয় বলে? বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তখনই তৈরি হবে, যখন প্রতিষ্ঠানের প্রথম ইট শক্ত ও মজবুত হয়। এগিয়ে আসুন, উচ্চশিক্ষার ফাউন্ডেশন স্টোন যত্নের সঙ্গে, অধ্যবসায়ের সঙ্গে তৈরি করি। গাঁয়ে-গঞ্জে, ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে, সদর মফস্সলে, জঙ্গলমহলে, গভীরতম গ্রামাঞ্চলে, পাহাড়ের কোনায়, সুদূরে, গভীরে।
একটা সহজ কথা, সহজ করেই বলি। আজকের গরিব দুঃস্থ ভারতীয় ছেলেমেয়েরাই তো আগামী কালের ভারতকে গড়বে। সেই আগামী দিনের কারিগরদের কথা ভাবুন। প্রাথমিক শিক্ষার দিকে মন দিন, ছোট ছোট ছড়িয়ে থাকা বিদ্যালয়গুলির উন্নতি করুন। প্রাথমিক শিক্ষাকে আর অবহেলা করবেন না। এই শিক্ষা যদি উন্নত না হয়, শিক্ষার আসল কাঠামো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। |
|
|
|
|
|