শিক্ষার্থীদের বছর নষ্ট হোক, ধর্মঘট জিন্দাবাদ |
অবশেষে বাংলার ১১ লাখেরও বেশি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অভিভাবকদের উৎকণ্ঠার অবসান হল। ২৮ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা ধর্মঘটের দিনটিতেই মাধ্যমিকের ইতিহাস পরীক্ষা নিয়ে রাজ্য সরকার এবং বাম জোটের মধ্যে মানা-না-মানার যে টানাপোড়েন চলছিল, তাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিভাবকসুলভ অরাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সকল বিদ্যার্থী এবং অভিভাবক তথা রাজ্যবাসীর শুধু স্বস্তির কারণই হয়নি, অকুণ্ঠ জনসমর্থনও আদায় করেছে। সাধারণ ভাবে এ মুহূর্তে দিন বদলের ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক জয় ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও যে-অনৈতিক গোঁয়ার্তুমি পরিস্থিতিগত অবস্থানে থাকার সুযোগ নিল ওঁরা বুঝতে পারছেন না, এর ফলাফল আগামী দিনে কী রকম প্রভাব ফেলতে পারে, যা কোনও মতেই বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখা উচিত হবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে-মানসিকতার রাজনৈতিক পাঠ নিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে আমরা ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো আদর্শগত ভাবে ধর্মঘটের বিরোধিতায় অনড় থেকে ২৮-এর ইতিহাস পরীক্ষার নির্ঘণ্ট বজায় রেখে বামপন্থী দলগুলিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারেন। কিন্তু অসহায় পরীক্ষার্থীদের কথা ভেবে তিনি অভিভাবকসুলভ নমনীয় ভাব নিয়ে দিন পরিবর্তন করলেন। রাজ্যবাসী এক সম্ভাব্য সমূহ সংঘাত থেকে বাঁচলেন। পরীক্ষার্থীরাও ইতিহাস রচনার জন্য এক দিন বেশি সময় পেয়ে গেল। |
ওই দিন পশ্চিমবঙ্গ বাদ দিয়ে দেশের অন্য কোনও রাজ্যে মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষা নেই এই দাবি তুলে বামপন্থী ধর্মঘটী রাজনৈতিক দলগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার জোরালো দাবি তুলে আসছিল। স্মরণে রাখতে হবে, শিল্প ধর্মঘটের দিনক্ষণ ঠিক হয় মাত্র কয়েক মাস আগে। অথচ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এই নির্দিষ্ট দিনের পরীক্ষার ঘোষণা করে রেখেছিল এক বছর আগে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজ্যের দরদি শ্রমিক নেতারা নিজ রাজ্যের এই পরীক্ষার দিনটির কথা মাথায় রেখেও কেন যে পরীক্ষার্থীদের অস্বস্তিতে ফেলার মতো সিদ্ধান্তে অটল রইলেন, ইতিমধ্যেই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তাঁদেরও তো কারও না কারও সন্তান এ বার পরীক্ষার্থী। যদি সরকার দিন পরিবর্তনে গররাজি থাকত, তা হলে এই বিপ্লবীরা কি তাঁদের সন্তানদের কষ্ট করে আর পরীক্ষা না-দেওয়ার ফতোয়া দিয়ে ধর্মঘটে শামিল হতে বলতেন?
সারা দুনিয়ার বামপন্থীদের কাছে প্রতিবাদ বা আন্দোলনের শেষ অস্ত্র হল ধর্মঘট। স্বাধীন ভারতে এই শেষ অস্ত্রটিকে কথায় কথায় এমন ভাবে সর্বত্র প্রয়োগ করা হয়েছে, যার ফলে মানুষের মনে হয়, বিরোধীরা একটা ‘ছুটি’ পাইয়ে দিল। সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, এটি একটি বিশ্রাম, মজলিস, আড্ডা বা জমিয়ে ভূরিভোজের দিন। অধিকাংশ লোকই বলতে পারবে না, কী মহৎ কাজের জন্য ওই ছুটির দিন। বন্ধ, ধর্মঘট, হরতাল, চাক্কা বন্ধ ইত্যাদিতে চিরকালই পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে। ধর্মঘট হলে কে কাকে শায়েস্তা বা নিয়ন্ত্রণ করে? তাই যদি হত, তা হলে পাহাড়ে ৪০, ৫০, এমনকী ৭৫ দিন লাগাতার ধর্মঘট ডেকেও ঘিসিং পাহাড়বাসীদের কিছু এনে দিতে পেরেছিলেন কি? খোঁজ নিয়ে দেখা হোক, বিগত ১০ বছরে এ রাজ্যে কতগুলি বন্ধ ডাকা হয়েছে আর কতগুলি ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। আর আলাদা করে জানানো হোক, এই হরতালের ফলে কী কী সুফল এসেছে।
নীহার মজুমদার। কলকাতা-৫৯
|
চার দিকে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারছি যে, এ বছর এই উপলক্ষে ১২ জানুয়ারি সরকারি ছুটি দেওয়া হবে। স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে সরকারি স্তরে সচেতনতা আমাদের আনন্দিত করে। ১৯৮৫ সালে ঘোষণা করা হয় যে, তাঁর জন্মদিন ‘জাতীয় যুব দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। তার পর থেকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় আকারে জাতীয় যুব দিবস উদ্যাপন করা হয়। এই উদ্যাপন তাঁর ভাব ও কর্মের সঙ্গে মানুষদের, বিশেষত যুবকদের, আরও বেশি করে পরিচিত করে তোলে। কিন্তু আমাদের মতে যুব দিবসে সরকারি ছুটির ঘোষণা বিবেকানন্দর বাণী প্রচারের কাজকে ব্যাহত করবে। বছরের অন্যান্য ছুটির মতো এটিও বাড়িতে সময় কাটানোর আর একটা উপলক্ষ হবে মাত্র। তার চেয়ে বরং স্কুলকলেজ চালু রেখে এই বিশেষ দিনে স্বামীজি সম্পর্কিত প্রতিযোগিতা, আলোচনাসভা ইত্যাদির আয়োজন করা যেতে পারে।
স্বামী ত্যাগরূপানন্দ। বেলুড় মঠ, হাওড়া
|
বিবেকানন্দের সার্ধশত জন্মোৎসবের মুখোমুখি হয়েও মঠের বাইরে শহর বেলুড়ের উদাসীনতা বিস্ময়কর। এত যে মানুষ আসবেন তাঁরা মঠে পৌঁছাবেন কী ভাবে? হাওড়া থেকে একটি ট্রেন দিনে মাত্র তিন বার যাতায়াত করে। সেই ট্রেনের সঙ্গে যোগ নেই বেলুড় স্টেশনের। বেলুড় থেকে মঠের রেল-যোগাযোগের খবর শিলান্যাসেই থেমে আছে। বাকি রইল বাসপথ। শালকিয়ার ওই পথ ধরে কয়েকখানা বাস এত মানুষকে মঠে পৌঁছে দেবে? সম্ভব নয়।
এখনই প্রতিদিন শয়ে শয়ে যাত্রী বেলুড়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ছেন জলকাদায়। অনেক চেষ্টা হয়েছে, তবু অটো চালু করা যায়নি। ভরসা একমাত্র রিকশা। ভাড়ার ঠিকঠাক নেই। উৎসবের দিন হলে তো কথাই নেই। কুড়ি হয়ে যায় চল্লিশ বা পঞ্চাশ।
উৎসব তো প্রায় শুরু হয়ে গেল। এখন এই বিপুলসংখ্যক মানুষের নিরাপত্তা, পানীয় জল, শৌচাগার, প্রাথমিক চিকিৎসা এ সব নিয়ে তো কাউকেই ভাবতে দেখা যাচ্ছে না। স্টেশনের পাশের হাসপাতালটিতে ইমার্জেন্সি বিভাগ এবং অ্যাম্বুল্যান্স কিছুই নেই। কিন্তু একটি স্থায়ী নির্দেশনামা আছে ‘হাওড়া হাসপাতালে নিয়ে যান’। ও দিকে শ্রমজীবী হাসপাতালেরও আর ক্ষমতা নেই বাড়তি চাপ নেওয়ার।
পরিকাঠামোগত এই সব অব্যবস্থার কথা বাদ দিলেও দেখা যাবে বেলুড়-বালিতে বিবেকানন্দ এক রকম ব্রাত্য হয়েই আছেন। এত বড় শহরে ওঁর একটিও মূর্তি দেখা যায় না। ওঁর নামাঙ্কিত একটি রাস্তা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নেই।
মাননীয় প্রণব মুখোপাধ্যায় সার্ধশত উৎসবের দায়িত্বে আছেন। তিনি উদ্যোগ নিলে এই সার্বিক উদাসীনতার লজ্জা অনেকটাই ঢাকা যাবে মনে হয়। তখন হয়তো বেলুড় স্টেশনের গায়ে এই শালপ্রাংশু মানুষটির একটি মূর্তি স্থাপনও হবে।
অরুণকান্তি দত্ত। সভাপতি, পূর্বাশা গ্রন্থাগার, বালি, হাওড়া |