নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে দল পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় সিপিএম নেতৃত্বের অন্যতম হাতিয়ার আপাতত ‘আত্মসমালোচনা’। এ বার সেই আত্মসমালোচনা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে দলের সম্মেলন-পর্বে! প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনা করে গোটা দলকেই মানুষের চোখে আরও ‘খলনায়ক’ করে তোলা হচ্ছে বলে সরাসরি নেতৃত্বকেই কাঠগড়ায় তুলল সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটি।
কলকাতা জেলা সম্মেলনের ‘রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদনে’ বলা হয়েছে, ‘নেতৃত্বের প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনা মানুষের মনে ধারণা তৈরি করছে, যে গোটা পার্টিটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে! নেতৃত্বস্থানীয় কমরেডরা সংবাদমাধ্যমের কাছে এমন বিবৃতি বা মতামত তুলে ধরেছেন, যাতে পার্টি শুধু বিব্রতই হয়নি। পার্টির ক্ষতি হয়েছে’। ৬৪ পাতার ওই প্রতিবেদনে দলের নির্বাচনী বিপর্যয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ কথাও কবুল করে নেওয়া হয়েছে ‘পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের কাজ উন্নীত করতে আমরা ব্যর্থ’। দলের একাংশের মতে, কলকাতা জেলা কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে এমন বক্তব্য থেকেই ইঙ্গিত মিলছে, আগামী মাসে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন কতটা আত্মসমালোচনা এবং পাল্টা সমালোচনায় বিদ্ধ হতে চলেছে!
প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে আজ, মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের কলকাতা জেলা সম্মেলন শুরু। আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্মেলনের সূচনা করার কথা দলের পলিটব্যুরো সদস্য তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। ঘটনাচক্রে, যিনি দলে আত্মসমালোচনার রাস্তায় অগ্র-পথিক! সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যায়, ‘প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনা’ দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে, এমন মত ব্যক্ত করে বুদ্ধবাবুদের পথ নিয়েই প্রশ্ন তুলল কলকাতা জেলা। বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর কলকাতা জেলা কমিটিই তাদের পর্যালোচনা রিপোর্টে নাম না-করে গৌতম দেবের মতো নেতাদের তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়া বহু মন্তব্যের দিকে আঙুল তুলেছিল। সেই ধারা বজায় রেখেই এ বার সম্মেলনে বুদ্ধবাবু, গৌতমবাবুদের ‘প্রকাশ্য আত্মসমালোচনা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হল।
বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারও প্রত্যাশিত ভাবেই ছাড় পায়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বামফ্রন্ট আর আগের মতো গরিবকে অগ্রাধিকার দেয় না, এই ধারণা দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। প্রশাসন দুর্বল হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করেছিল মানুষ’। গত বিধানসভা ভোটে ২৩৫টি আসনে জিতেও বামফ্রন্ট সরকার যে কাজের কাজ বিশেষ করতে পারেনি, তারও সমালোচনা রয়েছে প্রতিবেদনে। বিরোধীরা ‘নৈরাজ্য’ সৃষ্টি করেছিল বলে উল্লেখ করার পাশাপাশিই ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে বলা হয়েছে, ‘এর জন্য বিরোধীদের থেকে প্রশাসনিক দুর্বলতাকে বেশি করে দায়ী করেছিল মানুষ’। দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে খুব বেশি ‘মৌলিক কাজ’ যে রাজ্য সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়, এই প্রচার মানুষের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার কাজেও ‘শিথিলতা’ দেখা দিয়েছিল।
সিপিএম সূত্রের খবর, পরাজয় থেকে শিক্ষা নিতে দলের যে ‘ব্যর্থতা’, তা কবুল করে নেওয়ার পাশাপাশিই এ বারের সম্মেলনে জেলায় কাণ্ডারী বদলাতে পারে দল। বর্তমান জেলা সম্পাদক রঘুনাথ কুশারী শারীরিক কারণেই দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ নিতে পারেন। তাঁর জায়গায় নতুন জেলা সম্পাদক হওয়ার দৌড়ে আছেন ব্রিগেড সমাবেশ-সহ কলকাতায় যে কোনও কর্মসূচি আয়োজনে বড় দায়িত্ব থাকে, রাজ্য কমিটির এমন এক সদস্য এবং কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক এক প্রবীণ নেতা। রাজ্য কমিটির সদস্য, কলকাতার এক প্রাক্তন মন্ত্রীর নামও দলে চর্চায় রয়েছে। প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যেই কলকাতার ২০টি জোনাল কমিটির মধ্যে ৭টির সম্পাদক বদল হয়েছে। কাশীপুর-বেলগাছিয়া, উত্তর কলকাতা, পূর্ব, কর্পোরেশন, খিদিরপুর-তারাতলা, দক্ষিণ-পূর্ব ও ঢাকুরিয়া জোনে নতুন সম্পাদক দায়িত্ব নিয়েছেন। গত সম্মেলনের পরে লোকসভায় হার দিয়ে সিপিএমের বিপর্যয়ের শুরু। তার পরে কলকাতা পুরসভা ও বিধানসভা ভোটে লাগাতার পরাজয়। বিধানসভা ভোটে কলকাতায় একটিও আসন না-পাওয়ার পরেও ভবানীপুর বিধানসভা এবং দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা উপনির্বাচনে ভরাডুবি অব্যাহত। এই ধারাবাহিক বিপর্যয় নিয়ে জেলা সম্মেলনে সরব হতে চান প্রতিনিধিরা।
তার আগেই খসড়া প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে
• কেন্দ্রীয় ভাবে ভোটার তালিকা স্ক্রুটিনিতে দুর্বলতা,
• নিবিড় প্রচারে ব্যর্থতা,
•
নির্বাচনের ঠিক আগে প্রচারে নামা,
• দলের বক্তব্যের সঙ্গে মানুষকে সহমত করে আনার প্রয়াসে ব্যর্থতা।
সিপিএমের মতো সংগঠন-নির্ভর দলে যার প্রত্যেকটিই ‘গুরুতর ত্রুটি’। ‘দক্ষ রাজনীতি-সচেতন’ এবং ‘মতাদর্শভিত্তিক’ কর্মী গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। মেনে নেওয়া হয়েছে এ কথাও যে, ‘বড় অংশের কর্মীরা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন। কেউ কেউ নির্বাচনের আগে প্রচারে নেমেছে বা আদৌ কাজে নামেনি’!
এমন ‘দুর্বল’ সংগঠন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোকাবিলায় আগামী দিনে কী ভাবে এঁটে উঠবে, তারই আলোচনা হবে তিন দিনের সম্মেলনে। |