দেশের সামগ্রিক আর্থিক পরিস্থিতি এবং ঢিমেতালে চলা বিশ্ব অর্থনীতির দিকে নজর রেখে কিছুটা সতর্ক ভাবে পা ফেলার ইঙ্গিত দিলেন রতন টাটা। নববর্ষ উপলক্ষে ‘সহকর্মী’দের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা স্থির করতে হবে। কারণ চলতি বছরটাও ‘সম্ভবত’ সঙ্কটের মধ্য দিয়েই কাটবে।
বছর তিনেক আগের মন্দার সময় নিজের গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের সম্প্রসারণ পরিকল্পনা সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখতে বলেছিলেন রতন টাটা। এ বারও তিনি সতর্ক। তবে ঝুঁকি নিতে পিছপা নন। তাই সম্প্রসারণ প্রকল্প বন্ধ রাখতে বলেননি টাটা। বিশেষ করে সুযোগ এলে তার সদ্ব্যবহার করতে যে সংস্থা প্রস্তুত, সেটাও একই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার। কারণ বিশ্বের কিছু প্রান্ত যখন টালমাটাল, অন্যান্য অঞ্চল তখন নতুন সম্ভাবনা গড়বে বলেই বিশ্বাস ‘ভারতীয় বহুজাতিক’ শিল্প গোষ্ঠীর কর্ণধারের। ‘সল্ট টু সফটওয়্যার’ সর্বত্র বিচরণ যার, সেই টাটা গোষ্ঠীর অধীনে ৯০টিরও বেশি সংস্থা রয়েছে। শীর্ষ কর্তাদের নতুন বছরে বরাবরই শুভেচ্ছা জানান টাটা। এ বারও অন্যথা হয়নি। গত ৩১ ডিসেম্বর পাঠানো সেই বার্তাতেই শুভেচ্ছার পাশাপাশি ২০১১-র অভিজ্ঞতা ও ২০১২-র আশা-আশঙ্কা ব্যাখ্যা করেছেন।
গোষ্ঠীর সমস্ত সংস্থাকেই তাদের ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলি খতিয়ে দেখতে বলেছেন তিনি। তাঁর পরামর্শ, বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আগামী দিনে বিভিন্ন সম্প্রসারণ প্রকল্পের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। এবং প্রয়োজনে উৎপাদন খরচ কমিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার পরামর্শও দিয়েছেন।
তবে তিনি শুধু হতাশার ছবিতেই বিশ্বাসী নন। আশঙ্কার দুনিয়াতেই সম্ভাবনার বীজও যে রয়েছে, তা জানিয়ে দিতে ভোলেননি টাটা। পশ্চিম ইউরোপ বা ব্রিটেনের পরিস্থিতির উন্নতি হতে কিছুটা সময় লাগলেও তাঁর আশা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আগেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এবং এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশ লগ্নির নতুন সুযোগ তৈরি করবে বলেও তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। ভারতে মূল্যবৃদ্ধির হারে লাগাম পরানো সম্ভব হলে সুদ কমতে পারে। সে ক্ষেত্রে সহজে ঋণ পাওয়ার রাস্তা সুগম হলে ভারতেও লগ্নিকারীদের আস্থা ফিরবে, প্রত্যয়ী মন্তব্য টাটা-র।
তাই সহকর্মীদর প্রতি তাঁর আর্জি, আগে যে-ভাবে এক সঙ্গে সবাই মিলে প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেছেন, এ বারও সেই ভাবে মন্দার বদলে নতুন বছরটিকে সাফল্যে বদলে দিন তাঁরা। বিশ্বের অগ্রণী দেশগুলির আর্থিক পরিস্থিতি যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, তখন ভারতে বৃদ্ধির হার বজায় থাকাটা আশাব্যঞ্জক বলেই মনে করছেন টাটা। তবে আলোর পিছনেই যে অন্ধকার রয়েছে, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দেশের শিল্প-কর্তারা যে সব বিষয় তুলেছিলেন (যেমন রাজনৈতিক মতানৈক্য, সরকারি সিদ্ধান্তে গড়িমসি ভাব), সে-সব উল্লেখ করেছেন টাটা-ও। বলেছেন মূল্যবৃদ্ধির জেরে নগদের জোগানে রাশ টানা এবং ঋণের খরচ বাড়ার সমস্যার কথাও। তাঁর মতে, এর ফলে লগ্নিতে ভাটা পড়ায় পরিকাঠামোর অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। যা সার্বিক ভাবে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পায়ে বেড়ি পরাতে পারে বলেই তাঁর আশঙ্কা।
তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও সহকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে টাটা গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক সাফল্যের খতিয়ান যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনই টু-জি কেলেঙ্কারির অভিযোগ থেকে ক্লিনচিট পাওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। তদন্তকারী সংস্থাগুলিও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পায়নি। যা এই গোষ্ঠীর নৈতিকতা ও মূল্যবোধকেই ফের প্রমাণ করে। টাটা জানিয়েছেন, ঝড়ঝাপটা-র বছরেও টাটা গোষ্ঠীর আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৪ লক্ষ ১৫ হাজার কোটি টাকা। টিসিএস এবং ল্যান্ডরোভার-জাগুয়ার-এর ব্যবসা বেড়েছে। তবে ইউরোপে চাহিদা কমায় ধাক্কা খেয়েছে ইস্পাতের ব্যবসা। |