তরজা শুরু দুই পক্ষে ন্যানোতেই যাত্রাভঙ্গ বিধায়কদের
সিঙ্গুর থেকে ন্যানোর সানন্দ-যাত্রা ঠেকানো যায়নি। এ বার সেই ন্যানো প্রশ্নেই এ রাজ্যের বিধায়কদের গুজরাত সফর আটকে গেল শেষ মুহূর্তে! প্রধান শাসক দল তৃণমূলের বিধায়কদের ‘আপত্তি’তে বিধানসভার শিল্প-বাণিজ্য দফতরের স্থায়ী কমিটির সফরটাই বাতিল হয়ে গেল। বিমানের টিকিট নিয়ে বিধানসভায় এসেও উড়ান ধরতে যাওয়া হল না কমিটি সদস্যদের!
সরকারি সূত্রের খবর, এত রাজ্যের মধ্যে শিল্পায়ন দেখতে শিল্প-বাণিজ্য সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি গুজরাতেই যাক, এমনটা চাননি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিটি যে সোমবার গুজরাত রওনা হচ্ছে, তা মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আসে রবিবার। নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যে শিল্পায়ন দেখতে যাওয়া, তা-ও আবার যে রাজ্যে টাটার ন্যানো কারখানা রয়েছে এমন ‘অনুষঙ্গ’ ভাল ভাবে নেননি মুখ্যমন্ত্রী। ওই স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান বামফ্রন্টের। ফলে এর মধ্যে ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’ দেখতে পায় সরকার পক্ষ। মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকারের মনোভাব বুঝেই কমিটির সদস্য, তৃণমূল বিধায়ক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন সকালে প্রথম আপত্তি তোলেন। কমিটির চেয়ারম্যান, ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী পরেশ অধিকারীকে ফোন করে তিনি জানিয়ে দেন, ন্যানো কারখানা দেখার পরিকল্পনা থাকলে তৃণমূল বিধায়কেরা গুজরাত যেতে চান না। বিষয়টিই ‘বিতর্কিত’ হয়ে উঠছে দেখে সফরই শেষমেশ বাতিল করা হয়।
বাতিলের সিদ্ধান্ত অবশ্য বাস্তবায়িত হয়েছে যথেষ্ট নাটকীয় ভাবে! কলকাতা থেকে আমদাবাদের বিমান ধরার জন্য দুপুরের উড়ানে টিকিট কাটা ছিল কমিটির পাঁচ সদস্যের। চেয়ারম্যান পরেশবাবু তাঁর জেলা কোচবিহার থেকে রবিবার এবং সিপিএমের সদস্য আনিসুর রহমান ভোররাতে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা রওনা দেন উড়ান ধরার জন্য। তারও আগে রীতিমাফিক শিল্প-বাণিজ্য দফতরের এক অফিসার ট্রেনে গুজরাত রওনা হয়ে যান। দু’জন অফিসারের যাওয়ার কথা ছিল কমিটির সঙ্গে। ট্রেন থেকে কলকাতায় নেমে পরেশ-আনিসুরেরা খবর পান, তৃণমূলের গুজরাত-যাত্রায় আপত্তি আছে! স্যুটকেস নিয়ে অগত্যা বিধানসভাতেই বসে ছিলেন তাঁরা! পরে পরেশবাবু বলেন, “শরীর খারাপ এবং আরও নানা কারণ দেখিয়ে তৃণমূল বিধায়করা সরে দাঁড়ালেন। তখন সফর স্থগিত করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। অথচ আলোচনা করেই সফরের পরিকল্পনা হয়েছিল।”
ঘটনাপ্রবাহে কমিটির মধ্যেই শাসক ও বিরোধী শিবির ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ কাজ করার জন্য পরস্পরকে দুষছে। তাঁর দফতরের আওতাধীন স্থায়ী কমিটি বলে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পদাধিকার-বলে তার ‘এক্স-অফিসিও’ সদস্য। কিন্তু গুজরাত যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে কমিটি কথা বলেনি বলেই পার্থবাবু জানান। যার জবাবে বাম বিধায়করা জানাচ্ছেন, এ সব কমিটির ক্ষেত্রে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা বাধ্যতামূলক নয়। তবে যে কোনও সফরের আগে বিধানসভার স্পিকারকে জানাতে হয়। তাঁদের দাবি, এ ক্ষেত্রেও তাঁরা জানিয়েছিলেন। পার্থবাবু বললেন, “হঠাৎ কেন ন্যানো দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা হল, বুঝলাম না! সিঙ্গুরে যখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, আদালতে মামলা চলছে, সেই সময় এমন পরিকল্পনার পিছনে কোনও উদ্দেশ্য আছে বলেই মনে হয়। রাজ্যের এই আর্থিক সঙ্কটের সময় এত দূরে দূরে সফরের পরিকল্পনাই বা কেন?” শিল্পমন্ত্রীর আরও প্রশ্ন, “গুজরাতে গিয়ে বিদ্যুৎ ক্ষেত্র দেখতে চাইলেও হত। অটো-মোবাইল হাব দেখার জন্য চেন্নাই, গুড়গাঁও বা পুণে ছেড়ে সানন্দ কেন?”
সিপিএমের আনিসুরের পাল্টা বক্তব্য, “গুজরাতে যাওয়ার পুরো পরিকল্পনাই তো কমিটিতে আলোচনা করে ঠিক হয়েছিল! ন্যানো কারখানা দেখতে গেলেই বা অসুবিধা কী ছিল? আমরা শিল্প দেখতে যাচ্ছিলাম, রাজনীতি নয়! আমি তো প্রস্তাব দিয়েছিলাম, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী সময় দিলে তাঁর সঙ্গেও দেখা করা হোক। গুজরাতে যে শিল্পায়ন হয়েছে, মানতে অসুবিধা কোথায়?” বস্তুত, সফর নিয়ে শাসক-বিরোধী এই চাপানউতোর শুরু হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, গুজরাতের মতো এই রাজ্যে কি দলমত নির্বিশেষে সহমতের ভিত্তিতে উন্নয়ন এর পর আদৌ সম্ভব?
কমিটি সূত্রে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, টাটার ন্যানো প্রকল্প যাওয়ার পরে সানন্দে ‘পিজিএ পুজো সিত্রোঁ’ এবং ফোর্ড যথাক্রমে ৪০০০ ও ৪৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে। দু’টি ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ হাজার করে। মারুতি-সুজুকি ওখানেই ৬ হাজার কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব দিয়েছে। যার জেরে পুণে, গুড়গাঁও, চেন্নাই ও উত্তরাখণ্ডের পরে সানন্দ ‘বৃহত্তম অটো-হাব’ হিসাবে দ্রুত গড়ে উঠছে। ঘনিষ্ঠ মহলে আনিসুরের মন্তব্য, “হতে পারে, ওখানে গিয়ে এ সব দেখলে তৃণমূলের মনে হত, সিঙ্গুরে কী হল না! তা-ই শিশুসুলভ আচরণ করল!”
তৃণমূল বিধায়ক রাজীববাবু তাঁর ট্যুইটারে গুজরাত-বিভ্রাটের জন্য বামেদের ‘দেউলিয়া রাজনীতি’কে দায়ী করেছেন। রাজীবের কথায়, “ওঁদের (কমিটির বাম সদস্য) তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি, অটো-মোবাইল হাব দেখতে চাইলে চেন্নাই বা গুড়গাঁওয়ে গেলে আমাদের অনেক লাভ হত। তা ছাড়া, গুজরাতের বিধানসভার স্পিকার এবং ওঁদের কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠক করে সাবরমতী আশ্রম দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ওঁরা হঠাৎ ন্যানো নিয়ে এলেন! ভুল প্রযুক্তির জন্য যে গাড়ির আগের মডেল টাটা-ই বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে!” রাজীবের পাশাপাশি আর এক তৃণমূল বিধায়ক অসিত মজুমদারও সফর থেকে সরে দাঁড়ান। তৃণমূলের বিধায়ক শিউলি সাহার যাওয়ার কথা থাকলেও সূচি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই তিনিও যাবেন না বলে জানান। কমিটির একমাত্র কংগ্রেস সদস্য ভূপেন্দ্রনাথ হালদার তাঁদের বুধবারের কৃষক-অবস্থানের জন্য যেতে চাননি।
ন্যানো বাদ দিয়ে বাকি গুজরাতে তো যাওয়া যেত? রাজীব বলেন, “সেটা বলতে পারব না। ন্যানো নিয়ে আমাদের আপত্তি ওঁরা মেনে নিয়েছেন।” আনিসুর বলেন, “১০ সদস্যের কমিটির এক-তৃতীয়াংশ সদস্য জুটলে তবেই কোথাও যাওয়া সম্ভব। তৃণমূল যখন এত আপত্তি তুলল, আমরা ক’জন (তিন জন) আর কী করতাম? সফরটাই বাতিল হল!” দিনভর গোটা ঘটনা দেখে সিপিএমের এক বর্ষীয়ান বিধায়কের স্বগতোক্তি, “সিঙ্গুর আন্দোলনের পরে এত ভোট হয়ে গেল। ন্যানোর ভূত তবু আমাদের পিছু ছাড়ছে না!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.