বিপর্যয়ের আতঙ্ক দিয়ে যেন শুরু হল নতুন বছর! ঘটনাস্থল ফের সেই পার্ক স্ট্রিট!
বর্ষশেষের রাতে আর নববর্ষের দিনভর আমুদে কলকাতার ‘প্রাণকেন্দ্র’ হয়ে থাকে যে রাজপথ, রবিবার সকালে সেই পার্ক স্ট্রিটের এক বহুতল থেকে বেরিয়ে এল ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এল দমকলের গাড়ি, রাস্তা জুড়ে বসে গেল পুলিশি ঘেরাটোপ। যে দৃশ্য খুঁচিয়ে তুলল স্টিফেন কোর্টের স্মৃতিকে। দু’বছর আগে পার্ক স্ট্রিটের প্রাচীন ওই বহুতলে আগুন লেগে ৪৩ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। তার উপরে আমরি-কাণ্ডের রেশ এখনও মেলায়নি। এমনকী, শনিবার দুপুরে স্টিফেন কোর্টেরই নীচে একটি রেস্তোরাঁয় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ফেটে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল।
তার চব্বিশ ঘণ্টা না-পেরোতেই আগুন লাগল পার্ক স্ট্রিটেরই আর এক বহুতলে।
পার্ক হোটেলের পিছনে এপিজে হাউস। দমকলের দাবি, এ দিন বেলা বারোটা নাগাদ বাড়িটির আটতলার সি ব্লকে অবস্থিত সার্ভার রুম থেকে আগুন ছড়ায়। ঘরটি ভস্মীভূত হয়ে গেলেও ছুটির দিনে বাড়ি প্রায় ফাঁকা থাকায় কেউ হতাহত হননি। দমকলকর্মীরা কয়েক জন নিরাপত্তারক্ষীকে বাইরে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন। দমকলের দশটি ইঞ্জিন গিয়ে দু’ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন আয়ত্তে আনে। চারপাশে বসে যায় পুলিশি কর্ডন।
|
এ দিকে ‘নিউ ইয়ার্স ডে’র আমেজ নিতে এ দিন দুপুর থেকে পার্ক স্ট্রিটে মানুষের ঢল নেমেছিল। রেস্তোরাঁগুলো ছিল ভিড়ে ঠাসা। তার মধ্যে আগুনের শিখা ও ধোঁয়া দেখে ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে গোটা তল্লাটে। বিশেষত আমরি-কাণ্ডের স্মৃতি এখনও টাটকা। তার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনায় প্রশাসনেও উদ্বেগ দেখা দেয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দফায় দফায় ফোন করে দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে খবরাখবর নেন। শহরের উৎসবের মেজাজে যাতে তাল না-কাটে, সে জন্য পরে বিবৃতি দিয়ে নাগরিকদের আশ্বস্তও করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “যা ঘটেছে, নিছকই দুর্ঘটনা। এতে ভয়ের কিছু নেই। সবাই আনন্দ করুন। বছরের প্রথম দিনটা উপভোগে অসুবিধার কিছু নেই।”
মমতা এ-ও জানিয়েছেন, দমকলের কাজে অসুবিধে হতে পারে ভেবেই এ দিন তিনি ঘটনাস্থলে যাননি। এমনিতেও দমকলের একটা মই-বসানো গাড়ি ঘটনাস্থলে আসতে গিয়ে পার্ক স্ট্রিট জোড়া আলোকসজ্জার ‘বাধা’য় আটকে গিয়েছিল। যথেষ্ট কষ্ট করে গাড়িটিকে ঢোকাতে হয়। মই লাগিয়ে এপিজে হাউসের আটতলার জানলা পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টা চলে। পাশাপাশি দমকলকর্মীরা শ্বাসযন্ত্র এঁটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার প্রয়াস চালান। ঘন ধোঁয়ায় তাঁদের এক জন অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে দমকল-সূত্রে জানানো হয়েছে।
এপিজে হাউসের প্রতিটি তলেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার অফিস। ছুটির দিনে কয়েক জন নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া বাড়িতে বিশেষ কেউ ছিলেন না। আটতলায় যেখানে আগুন লাগে, তার পাশের ব্লকের এক অফিসের নিরাপত্তাকর্মী রতন পাণ্ডে আগুন দেখেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। রতনবাবুর কথায়, “সবে স্নান করতে ঢুকেছি। বাথরুমের জানলা দিয়ে দেখলাম, গলগলিয়ে কালো ধোঁয়া! আমাদের অফিসেও ঢুকছে। আমরি’র কথা মনে পড়ে গেল। অফিসের শাটার নামিয়ে ধোঁয়ায় ঢাকা সিঁড়ি দিয়ে পড়ি-মড়ি দৌড়ে নেমে এলাম।” |
তবে এ দিনের বিপদ মোকাবিলায় লাগোয়া পার্ক হোটেল কর্তৃপক্ষ যে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন, দমকল ও পুরসভার তরফে তা স্বীকার করা হয়েছে। পার্ক হোটেলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বিজয় দিওয়ান বলেন, “আগুন নেভাতে আমরা দমকলকে সব রকম সাহায্য করেছি। আমাদের নিজস্ব জলাধারটিও কাজে লেগেছে।” এপিজে হাউসের আটতলার কাছাকাছি হোটেলের সাঁতারপুল সংলগ্ন একটি লাউঞ্জবারও নিরাপত্তার স্বার্থে সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আগুন লাগল কী ভাবে?
দমকল-কর্তাদের বক্তব্য, সার্ভার রুমে এসি মেশিনে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন ছড়াতে পারে বলে প্রাথমিক ভাবে তাঁরা মনে করছেন। দমকলমন্ত্রীর কথায়, “আগুন লাগার কারণ খতিয়ে দেখতে একটি মামলা রুজু করা হবে।” মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যেটুকু খবর পেয়েছি, তাতে জানতে পেরেছি, ওই অফিসের ফায়ার অ্যালার্ম ও স্মোক ডিটেক্টর কাজ করেছে। তবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় কোনও খামতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।”
পার্ক স্ট্রিটের পরিস্থিতি এ দিন দ্রুত আয়ত্তে এলেও কলকাতায় পরের পর অগ্নিকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। এ দিন এপিজে হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “শহরে বিভিন্ন জায়গায় কেন এত ঘন ঘন আগুন লাগছে, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।” |