নতুন বছরের প্রথম দিনেই সংস্কারের পথে নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল মনমোহন-সরকার।
আজ অর্থ মন্ত্রক ঘোষণা করেছে, বিদেশি নাগরিকরা এ বার সরাসরি এ দেশের শেয়ার বাজারে লগ্নি করতে পারবেন। এত দিন পর্যন্ত শুধু বিদেশি আর্থিক সংস্থা ও অনাবাসী ভারতীয়দেরই (এনআরআই) এই অনুমতি দেওয়া হত। কিন্তু নতুন করে বিশ্ব জোড়া মন্দার আশঙ্কায় বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলি এ দেশের বাজার থেকে লগ্নি তুলে নিতে শুরু করেছে। যার ফলে বেড়েছে ডলারের চাহিদা। পড়েছে টাকার দাম। শেয়ার বাজারের সূচকের পতনেও তা ইন্ধন জুগিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিদেশি ব্যক্তিগত লগ্নিকারীদের (সরকারি ঘোষণার ভাষায়: কোয়ালিফায়েড ফরেন ইনভেস্টর) জন্যও শেয়ার বাজারের দরজা খুলে দেওয়া হবে। অর্থ মন্ত্রক আশা করছে এর ফলে তিনটি সুফল মিলবে। এক, বিদেশি লগ্নির পরিমাণ বাড়বে। দুই, আর্থিক অবস্থার ভিত মজবুত হবে। তিন, শেয়ার বাজারের টালমাটাল অবস্থা কাটবে। |
দেশের বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ টানতেই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মনমোহন সিংহ-প্রণব মুখোপাধ্যায়রা। কিন্তু শরিক তৃণমূলের চাপে এবং কংগ্রেসের অন্দরে আপত্তিতে সেই সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রাখতে হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। পেনশন তহবিল, বিমা ক্ষেত্রেও সংস্কার করে বিদেশি লগ্নি টানার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ঘরে-বাইরের চাপে সেখানেও পিছু হটতে হয়েছে ইউপিএ সরকারকে। ফলে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আনার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলি এ দেশের শেয়ার বাজার থেকে লগ্নি তুলে নিয়ে যাওয়ায় ‘কারেন্ট অ্যাকাউন্ট’-এ ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছিল। আজ তাই বিকল্প পথ খোঁজার চেষ্টা করেছেন মনমোহন-প্রণব। একই সঙ্গে তাঁদের আশা, বিদেশি নাগরিকদের সরাসরি শেয়ার বাজারে লগ্নির অনুমতি দেওয়ার ফলে দেশের শিল্প মহলেও বার্তা যাবে যে, সরকার আর্থিক সংস্কারের পথ থেকে সরছে না।
তবে এই সিদ্ধান্ত ঘিরেও রাজনৈতিক বাদ-প্রতিবাদের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বামেরা এমনিতেই দেশীয় বাজার বিদেশিদের সামনে খুলে দেওয়ার বিরোধী। আজ সরকারি ঘোষণার পরে একান্ত আলোচনায় বাম নেতারা বলছেন, আর্থিক সংস্থার বিনিয়োগে তবু সরকারি নিয়ন্ত্রণের একটা সুযোগ থাকত। কিন্তু ব্যক্তিগত লগ্নির ক্ষেত্রে সেই নিয়ন্ত্রণ কতটা রাখা যাবে, সেটা অনিশ্চিত। শেয়ার বাজার স্থিতিশীল হওয়ার যে যুক্তি সরকারি তরফে দেওয়া হচ্ছে, তাকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন বাম নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, ব্যক্তিগত লগ্নিকারীরা বরং আরও স্বল্প সময় টাকা রেখে মুনাফা করে চলে যাবেন। যার জেরে শেয়ার বাজারের মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়বে। তবে এ নিয়ে দলীয় স্তরে কোনও বিবৃতিই আজ চার বাম দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। বলা হচ্ছে, আগামিকাল বিষয়টি নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেই যা বলার বলা হবে। দলে আলোচনার আগে এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি তৃণমূলের কোনও নেতাও।
আজ অর্থ মন্ত্রকের জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এত দিন বিদেশি নাগরিকরা শুধু মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে এ দেশের শেয়ার বাজারে লগ্নি করতে পারতেন। কিন্তু এ বার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ডের (সেবি) নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকলেই কোনও বিদেশি নাগরিক বা তাঁদের গোষ্ঠী সরাসরি লগ্নি করতে পারবেন। ব্যক্তিগত ভাবে এক জন বিদেশি নাগরিক ভারতীয় সংস্থার ৫ % পর্যন্ত শেয়ার কিনতে পারবেন। দলবদ্ধ ভাবে তাঁরা ১০ % পর্যন্ত শেয়ারের মালিক হতে পারবেন। ১৫ জানুয়ারি থেকে এই নতুন নিয়ম চালু হবে।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, বিদেশি নাগরিকরা অনেক দিন ধরেই এ দেশের শেয়ার বাজারে লগ্নি করতে আগ্রহী। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ২০১১-’১২ সালের বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বিদেশি নাগরিকদের মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ১৩০০ কোটি ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তী ধাপে শেয়ার বাজারে সরাসরি বিনিয়োগের অনুমতি তাই যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ। বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে যা আরও বেশি করে জরুরি হয়ে পড়েছে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ফের বিশ্ব জোড়া আর্থিক মন্দার ভ্রূকুটির মুখে এ দেশের শেয়ার বাজারে যে ভাবে লাগাতার পতন চলছে, তাতে নতুন লগ্নি সন্ধান করা ছাড়া সরকারের হাতে অন্য কোনও উপায় ছিল না। গত কাল শেষ হওয়া বছরে লগ্নিকারীরা শেয়ার বাজারে মোট ১৯ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ খুইয়েছেন। এর মধ্যে বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলির ক্ষতির পরিমাণ ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। যা মোট ক্ষতির ১০ শতাংশ।
সেবি-র হিসেবে, ২০১১ সালে বিদেশি আর্থিক সংস্থারগুলি ছয় লক্ষ টাকা কোটি টাকার শেয়ার কিনেছিল। কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ শেয়ার তারা বিক্রি করে দিয়েছে। যার ফলে চূড়ান্ত হিসেবে দেখা যাচ্ছে, এ দেশের শেয়ার বাজার থেকে ২৭০০ কোটি টাকার বিদেশি লগ্নি বাইরে চলে গিয়েছে। যার জেরে গত বছর সব মিলিয়ে সেনসেক্স পড়েছে প্রায় ৫ হাজার পয়েন্ট, অর্থাৎ ২৪ শতাংশ। ২০১০ সালে কিন্তু হিসেবটা ছিল উল্টো। সে বছর ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিদেশি লগ্নি ভারতে এসেছিল। সেনসেক্স-ও বেড়েছিল ১৭ শতাংশের বেশি।
চলতি বছরে পরিস্থিতি শোধরাতে তাই আজকের সিদ্ধান্ত। এ জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সেবি নতুন নিয়মাবলি তৈরি করবে। লগ্নি করতে ইচ্ছুক বিদেশি নাগরিকদের ‘ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স’-এর নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। সেবি-স্বীকৃত সংস্থার মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকরা একটি ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট ও শেয়ার কেনাবেচার জন্য একটি ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন।
এ ছাড়া, মিউচ্যুয়াল ফান্ডেও যাতে বিদেশি নাগরিকরা আরও বেশি করে লগ্নি করতে পারেন, তার জন্য নিয়মনীতি শিথিল করতেও সেবি-র কাছে আবেদন জানিয়েছে মিউচ্যুয়াল ফান্ড পরিচালন সংস্থাগুলি। |