পুলিশ এক লরিচালককে খুঁজছে। আবার ওই লরিচালককেই দুই শিশুর পিতাও খুঁজছেন। কোন অপরাধের জন্য নয়। রাতভোরে দুই শিশু বাড়ি যাব বলে স্কুল থেকে পালিয়ে রাস্তা ভুল করেছিল। বান্দোয়ানমুখী ওই লরিচালক দুই শিশুকে রাস্তায় আনমনা ঘুরতে দেখে গাড়িতে তুলে নেয়। বান্দোয়ান থানার সামনে পথচলতি এক বাসিন্দাকে জানিয়ে লরি নিয়ে চলে যান চালক। গেট খুলিয়ে থানায় শিশু দুটিকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। বেলার দিকে স্কুলের শিক্ষক ও পরিবারের সদস্যদের হাতে শিশু দু’টিকে তুলে দেয় পুলিশ।
ওই লরিচালককে তাই খুঁজছেন বান্দোয়ানের গুরুড় গ্রাম পঞ্চায়েতের সাগা-সুপুরুতি গ্রামের বাসিন্দা, পেশায় চাষি হলধর মাহাতোও। কারণ ওই লরিচালক যে দু’টি শিশুকে থানায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, সেই ছ’বছরের দীনেশ আর সাড়ে চার বছরের বিকাশ যে তাঁরই দুই নাতি! মঙ্গলবার দুপুরে হলধরবাবু বললেন,‘‘ ওই লরিচালক ভাগ্যিস দুজনকে দেখতে পেয়েছিল। নাহলে কী যে হত কে জানে!” তিনি জানান, দীনেশ তাঁর বড় ছেলে লালমোহনের ছেলে। আর বিকাশ বড় মেয়ের ছেলে। হলধরবাবুর কথায়, “২৪ ডিসেম্বর ওই দু’জনকে বান্দোয়ানে একটি বেসরকারি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম। ওদের বাবা অস্থায়ী কর্মী হিসাবে প্রতিদিন টাটায় কাজ করতে যায়। ছেলেগুলো লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে ভেবে ওখানে ভর্তি করেছিলাম।”
লালমোহনবাবু বলেন, “আমরা স্বামী স্ত্রী দু’জনেই অস্থায়ী চাকরি করি। বাড়িতে বাচ্চাকে দেখাশোনার কেউ নেই। তাই ওদের দু’ভাইকে বান্দোয়ানের ওই স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম। দীনেশের কাছ থেকে জেনেছি ওখানে ভর্তি হবার পরই ওর স্কুলে মন টিকত না। তাই পিসতুতো ভাই বিকাশকে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়েছিল।” তৃণমূলের বান্দোয়ান ব্লক সভাপতি জগদীশ মাহাতো বলেন, “দুই শিশুর কাছ থেকে জানতে পেরেছি, এ দিন ভোরে স্কুলের গেট খোলা পেয়ে তারা বাইরে বেরিয়ে হাঁটা লাগায়। মধুপুর গ্রামের কাছে এসে ওরা রাস্তা ঠাহর করতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বান্দোয়ানমুখী একটি লরি ওই সময় আসছিল। দুই শিশুকে রাস্তায় আনমনা ঘুরতে দেখে কোথায় যাবে জিজ্ঞাসা করে। ছোট্ট দুই ভাই কিছুই জানাতে পারেনি। লরিচালক তখন ওদের থানার গেটের সামনে ওদের নামিয়ে দিয়ে চলে যান।”
বান্দোয়ান-মানবাজার রাস্তার ধারের ওই বেসরকারি আবাসিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক নীলকমল মাহাতো অবশ্য দাবি করেছেন স্কুলের গেট বন্ধই থাকে। তাঁর দাবি, “স্কুলের মূল গেট তালা দেওয়া থাকে। কারণ অনেক পড়ুয়ার পাশাপাশি আবাসিক হিসাবে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরাও এখানে থাকেন। এদিন কোন শিক্ষক ভোরের দিকে বাইরে গিয়েছিলেন। সেই সময়ই দীনেশ ও বিকাশ বাইরে বেরিয়ে পড়ে। খানিক পরে শিক্ষকরাই জানতে পারেন তারা বাইরে বেরিয়েছে। আমরা সবাই মিলে শীতের ভোরে খোঁজ শুরু করি।” স্কুল-শিক্ষকদের একাংশও জানিয়েছেন, দু’জনেই নার্সারির ছাত্র। দু’তিন দিন আগে ওই দু’জন ভর্তি হয়েছিল। এখানে মন টিকছে না, তাই বাড়ি যাবে বলে সহপাঠীদের তারা জানিয়েছিল।
বান্দোয়ানের ওসি দীপঙ্কর সরকার বলেন,“শীতের ভোরে শিশু দু’টোকে ওই অবস্থায় দেখে সত্যিই খারাপ লাগছিল। ওদের খাবার ও গরম পোশাক দিই। তবে ওই লরিচালক ধন্যবাদ পাওয়ার মতোই কাজ করেছেন।’’ সাগা-সুপুরুতি গ্রামের বাসিন্দা ভৈরব মাহাতো বলেন, “আমাদের লাগোয়া গ্রাম চাঁদড়ার এক বাসিন্দার কাছে প্রথম জানতে পারি, আমাদের গ্রামের দুই শিশু পুলিশের জিম্মায় রয়েছে। তখন শিশুদের পরিবাররের সদস্যদের খবর দিই।” বেলার দিকে ওই আবাসিক স্কুলের শিক্ষক সুশান্ত সরেন ও রাজু মাহাতো থানায় আসেন। একটু পরেই হাজির হন শিশু দু’টির দাদু হলধরবাবু।
হলধরবাবুর কথায়, “ওই লরিচালক ভাগ্যিস দু’জনকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিল। কিছুটা দূরেই ঝাড়খণ্ডের এলাকা। ওই লরিচালক যে কাজ করেছেন, তাতে কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।” |