চেয়ারিং ক্রস থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকে ট্রাফালগার স্কোয়ারের দিকে হাঁটতে শুরু করা মাত্রই, বুকের ভিতর গুরু গুরু শব্দ! পায়ে পায়ে ক্রিসমাসের ভিড় ঠেলে ন্যাশনাল গ্যালারির দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছি, শব্দটা বাড়ছে। লন্ডন কাঁপছে শীতে, ক্রিসমাসের বাজারি হাঁকডাকে আর লিয়োনার্দো জ্বরে। নানা দেশ থেকে, বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে, লাল ফিতের ফাঁস পেরিয়ে লিয়োনার্দোর সারা জীবনে আঁকা ছবির অধিকাংশই উপস্থিত হয়েছে এখানে, এক ছাদের তলায়। এ হেন প্রদর্শনী আর কোথাও হয়নি, আর কখনও হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর এই প্রদর্শনীর মধ্যমণি শতাব্দীর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া, সদ্য আবিষ্কৃত লিওনার্দোর একুশতম ছবি‘সালভাতোর মুন্ডি’ জগৎ পরিত্রাতা! দু’চোখে আরনো নদীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চিত্রশালার সেন্সবেরি উইং দিয়ে উগরে উঠছি, মৃদু ভায়োলিনের শব্দে বুকের দামামা আরও জোরে বাজছে, আর মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তগুলোর জন্যেই বোধহয় দেশ থেকে এত দূরে পাতাঝরা-শীতার্ত-অন্ধকার লন্ডনে রয়ে যাওয়াটা সার্থক।
আমি প্যারিসের লুভ্ মিউজিয়ামে মোনালিসার সঙ্গে দেখা করেছি, কিন্তু নানান স্কেচ, মিউজিশিয়ানের অসাধারণ পোর্ট্রেট পেরিয়ে যখন এসে দাঁড়ালাম ‘The lady with the Ermine’ এর সামনে, আমার হাত-পা অবশ! ঠিক তার পাশেই ‘লা বেল্লে ফেরোনেইর’ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এরা অপরূপা, কিন্তু কোথায় যেন কিছু লুকিয়ে রেখেছে। জোনাকির রঙে ঝিলমিল করে ওঠা চোখের ভাষা, হাতের পেলবতায় শ্রাবস্তীর কারুকার্য আর মুখে হালকা লেগে থাকা হাসি আমায় প্রশ্ন করল ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ |
পাশের ঘরে খুব ভিড়। কানের যন্ত্রে বিবরণী শুনতে শুনতে ঢুকে পড়া গেল কোনও রকমে। ভিড় একটু পাতলা হতেই আমার সামনের ছোট ক্যানভাস থেকে ছলছল শব্দে, পৌষ সন্ধেয় জেগে উঠল ‘ম্যাডোনা লিতা’। অনন্ত মাতৃরূপ ফুটে আছে গাঢ় শান্তি হয়ে, স্তন্যপানরত শিশুর মুখের গন্ধ ভেসে আসছে, মানুষ-দেবী মিলেমিশে এক। কখন যে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছি, জানি না, চোখ সজল। ভ্যাটিক্যানে মিকেলাঞ্জেলোর ‘পিয়েতা’র সামনে দাঁড়িয়ে একই অনুভূতি হয়েছিল।
তিন বছর আগে সুইজারল্যান্ডে হঠাৎই খুঁজে পাওয়া গেছে ‘বেল্লা প্রিন্সিপিয়া’ লিয়োনার্দোর আঁকা এক তরুণীর ছবি। সেই সূক্ষ্ম পর্দার পর পর্দা চড়ানো মোলায়েম তেলরঙের খেলা, সেই ‘স্ফুমাতো’ শৈলীর বিক্ষেপে ফুটে ওঠা নম্র মধুরতা। লিয়োনার্দোর সমস্ত ছবিতেই রয়েছে এক ইন্দ্রিয়াতীত, অপার্থিব জগতের ইঙ্গিত, সৌন্দর্য জাগিয়ে তোলে এক দিব্য অনুভূতি। সদ্য খুঁজে পাওয়া ‘সালভাতোর মুন্ডি’-ও এমন অদ্ভুত আলোয় মোড়া ডান হাত আশীর্বাণীতে উত্থিত, বাঁ-হাতে এক গোলাকার স্ফটিক, দু’চোখে নিবিড় সুশান্ত দৃষ্টি। ১৯৫৮ সালে ব্রিটিশ শিল্প ঐতিহাসিক হার্বার্ট কুক এটি বিক্রি করেন মাত্র পঁয়তাল্লিশ পাউন্ডে। পরে ছবিটি পৌঁছয় আমেরিকায়। এখন ছবিটির নির্ণীত মূল্য প্রায় ১২৬ মিলিয়ন পাউন্ড।
তিন বছরের মধ্যে দু’টি আসল লিয়োনার্দো খুঁজে পাওয়া প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ইতিহাসের অনেক গলিখুঁজি ঘুরে চিত্র দু’টি কী ভাবে সামনে এল, সে এক ডিটেকটিভ গল্পের মতো। ‘বেল্লা প্রিন্সিপিয়াতে’ স্পেকট্রাল ডিজিট্যাল স্ক্যানার-এর তলায় বাঁ-হাতি লিয়োনার্দোর আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ ছবি জাল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে অনেক। রবীন্দ্রনাথের খুঁজে পাওয়া কুড়িটি ছবি নিয়ে সম্প্রতি কলকাতায় যে ঝড় উঠেছিল, প্রদর্শনীর পরে জানা গেছে যে ছবিগুলি জাল। এই নিয়ে জলঘোলা, কোর্ট-কাছারি চলেছে। লিয়োনার্দোর সদ্য আবিষ্কৃত ছবি নিয়ে হইচই, তর্ক, গবেষণা হবে এ আর আশ্চর্য কী?
নিউইয়র্কের শিল্প-ব্যবসায়ী রবার্ট সাইমন সাত বছর আগে হাতে পেলেন প্রায় ভঙ্গুর, কয়েক শতাব্দী ধরে সংস্কারের চেষ্টায় এলোমেলো রঙের পোচ লাগানো রেনেসাঁস আমলের এক ছবি। প্রথম দর্শনে সাইমনের মনেই হয়নি, এটা লিয়োনার্দোর আঁকা কারণ সে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তোলা হাতে যে ম্যাজিক ছিল, তা সাইমনকে ভাবিয়ে তুলল। তিনি কালো জঞ্জালের ব্যাগে ভরে ছবিটি নিয়ে গেলেন ৯৮ বছর বয়সি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মারিয়ো মডেস্তিনির কাছে। মারিয়ো ও তাঁর গবেষক স্ত্রী ডায়না তেল দিয়ে ঘষে ঘষে কিছু বাড়তি রঙের পোচ তুলে ফেলতেই ধীরে ধীরে নজরে এল খ্রিস্টের লম্বা নেমে আসা চুলের অসামান্য হিল্লোল! নিখুঁত সে পেলব তুলির আঁচড়। এমন ম্যাজিক সে সময় আর কার হাতে ছিল? ২০০৭-এ শুরু হল ছবির সংস্কারের আধুনিক প্রয়াস। সবারই জানা ছিল যে লিয়োনার্দো ‘সালভাতোর মুন্ডি’ এঁকেছিলেন, অনেক স্কেচ পাওয়া গেছে আগেই। তা ছাড়া পরের বিভিন্ন শতাব্দীতে আঁকা এই ছবির অনেক কপি আছে বাজারে, কিন্তু আসলটি গিয়েছিল কালের অন্ধকারে হারিয়ে।
২০০৮ সালে মিলান-অক্সফোর্ড-ওয়াশিংটন-নিউইয়র্ক থেকে মার্টিন কেম্প-এর মতো বিশ্ববন্দিত পণ্ডিতেরা জড়ো হলেন লন্ডনে। অন্যত্র খুঁজে পাওয়া খ্রিস্টের পোশাকের, গলার অঙ্গহারের স্কেচ-এর সঙ্গে পাওয়া গেল বহু ছবির হুবহু মিল। ইনফ্রা রেড রশ্মি দিয়ে দেখা গেল, অনেক পোঁচ রঙের তলায় লিয়োনার্দোর প্রথম স্কেচ খ্রিস্টের বুড়ো আঙুলের একাধিক অবস্থান। লিয়োনার্দো ডান হাতে তাঁর ছবির রং ঘষে পাতলা করে তুলতেন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সেই ডান হাতের ছাপও মিলে গেল নিখুঁত। খ্রিস্টের ডান হাতে ধরা গোলাকার স্ফটিক আর তার আলো বিচ্ছুরণও লিয়োনার্দোর নিখুঁত শিল্পভাবনা ও আলোর প্রতিসরণের বৈজ্ঞানিক চিন্তার সঙ্গে মিলে যায়। বাম ও ডান মস্তিষ্ক কাজ করছে এক সঙ্গে লিয়োনার্দোর ‘জিনিয়াস’ ছাড়া আর কার পক্ষে এ সম্ভব?
ন্যাশনাল গ্যালারির মহানির্ধারক নিক পেনি বললেন, প্রথম দর্শনেই তিনি জানতেন, এ সৃষ্টি আর কারও নয় লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চির। গবেষকরা প্রায় সবাই একমত হলেও এত সহজে কি মেনে নেওয়া যায়? লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রাঙ্ক জোলনার বললেন খ্রিস্টের নাক বড় লম্বা, লিয়োনার্দোর মতো খুঁতখুঁতে লোক কি এ ভুল করবেন?‘সালভাতোর মুন্ডি’ সত্যি সত্যিই লিয়োনার্দোর আঁকা কি না এই নিয়ে আরও বিতর্ক হবে। এ ছবি ১০০ শতাংশ আসল কি না, হয়তো কখনওই জানা যাবে না। কিন্তু ছবিটার দিকে তাকিয়ে, ছবি আঁকা নিয়ে ছাত্র বোলত্রাফিয়োকে লিয়োনার্দোর দেওয়া উপদেশ মনে পড়ে গেল আমার। ‘মোতি দেল্লা নিমা’ ছবির উত্তরণের জন্যে চাই হৃদয়ে সঞ্চরণ movement of the soul! |