|
|
|
|
প্রবন্ধ ১...
যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
|
সবচেয়ে দীর্ঘ এক মিনিট,
তার চিন্তা |
|
কোনও অনুষ্ঠানে প্রয়াত ব্যক্তির স্মরণে যখন এক মিনিট নীরবতা পালিত হয়,
আমরা মনে মনে কী নিয়ে ভাবি সেই সময়টায়?
ঈশ্বর-অবিশ্বাসীর চিন্তার খোঁজ নিয়েছেন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
এখন নানা কারণেই মাঝে মাঝে শোকপ্রস্তাব নিতে হয়। এক জন কেউ এক মিনিট নীরবতা পালনের প্রস্তাব করেন, সবাই উঠে দাঁড়ায়, সামনের দিকে হাত, দৃষ্টি মাটির দিকে। পৃথিবীতে এ রকম লম্বা এক মিনিট আছে কি না সন্দেহ। অনেকেই আড় চোখে বার বার ঘড়ি দেখে নেয়।
এই এক মিনিটে মানুষ কী ভাবে? ঘোষণা করা হয় যে সদ্য মৃত এক জন বা কয়েক জনের পরলোকগত আত্মার শান্তির উদ্দেশে... আমার মুশকিল হচ্ছে, আমি তো পরলোকে বিশ্বাস করি না। পরজন্ম বলে কিছু নেই। স্বর্গ-টর্গ সবই সুমধুর কল্পনা মাত্র। এই পৃথিবীতে শেষ নিশ্বাস ফেলা মানেই চরম শেষ, সে আর কোথাও নেই। আত্মার অস্তিত্বেও আমি বিশ্বাস হারিয়েছি অনেক কাল আগে। আত্মাও মুনি-ঋষি, দার্শনিকদের মনগড়া একটা ব্যাপার, মৃত্যুর পর মানুষের শরীর থেকে কিছুই বেরিয়ে যায় না। ঈশ্বরের অস্তিত্বও স্বীকার করার কোনও কারণ নেই, বিগ ব্যাং ঘটেছে প্রাকৃতিক কারণে, তার আগে সময়েরও অস্তিত্ব ছিল না, সময়ও ছিল না? কী সাঙ্ঘাতিক কথা!
অনেকের হৃদয়ে ভক্তি ও বিশ্বাসে এক জন ঈশ্বর আছেন, যিনি শুধুমাত্র এই ছোটখাটো পৃথিবীটা চালান, যিনি পেটের অসুখ সারিয়ে দেন, পরীক্ষায় পাশ করান, যাঁর নামে কান্নাকাটি করে বহু মানুষ বিপদে বা দুঃখের দিনে সান্ত্বনা পায়। এই ঈশ্বরের অধীনে একটা চমৎকার স্বর্গ আছে, নরকও আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সব ধর্মেই তো আলাদা আলাদা ঈশ্বর, অথচ ধর্মগুলি একেশ্বরবাদী। সেই একাধিক ঈশ্বর স্বর্গে বসে নিজেদের মধ্যে কখনও বিবাদ করেন কি না জানি না, তবে পৃথিবীতে তাঁদের ভক্তরা বীভৎস হানাহানি করেছে বহুবার। এখন মহাকাশের মানচিত্র যতটা পাওয়া গেছে, তাতে আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীকে আলাদা করে রাখার কোনও উপায় নেই। পৃথিবীটা একটা অতি সামান্য গ্রহ, সূর্যও নিতান্তই এক ছোটখাটো নক্ষত্র, আরও কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে এই মহাবিশ্বে, তাদের মধ্যে বড়সড় যে-কোনও একটিই একশোটা পৃথিবীর সমান। একই জন্মলগ্নের পর এরা ছুটছে আবার পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সে ছবি দেখলে খানিকটা আতঙ্কই হয়, এত লক্ষ কোটি গ্রহ-নক্ষত্রের জন্ম হল কেন, কী উদ্দেশ্যে? তারা কি ছুটে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে? মাঝে মাঝে রাক্ষসের মতন ব্ল্যাক হোল, যারা কাছাকাছি কোনও গ্রহ-তারকা পেলেই কপাত করে গিলে ফেলে, এমনকী আলোর রশ্মিরও নিস্তার নেই। গ্রহ-নক্ষত্র ছাড়াও অনেক বড় বড় ঢেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাকাশে। তাদের কয়েকটা যদি ছুটে এসে আছড়ে পড়ে এই পৃথিবীতে, তা হলেই আমাদের লীলাখেলা শেষ, কোনও ঈশ্বরই আমাদের বাঁচাতে পারবেন না বোধহয়। একবার তো হয়েছিলও তা-ই, যখন পৃথিবীতে ডায়নোসরের মতো বিদঘুটে বড় আকারের প্রাণীরা রাজত্ব করত, এক ঝাঁক উল্কার আঘাতেই তারা সব শেষ। ডায়নোসরদের কোনও ঈশ্বর ছিলেন না সম্ভবত। |
|
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মরণ অনুষ্ঠান। নন্দন, ১২ এপ্রিল, ১৯৯৫ |
সভাপতি বললেন, এক মিনিট শেষ, আপনারা বসুন। এই এক মিনিটের মধ্যে আমি এত সব ভেবে ফেললাম?
কোনও কোনও শোকপ্রস্তাবের সময় দেখেছি, যিনি প্রস্তাবক, তিনি এক মিনিট নীরবতার কথা বললেও নিজেই অধৈর্য হয়ে পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড হতেই ইঙ্গিত করেন যে, সময় পূর্ণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, ওই সব শোক প্রস্তাবক পনেরো সেকেন্ড সময় চুরি করে নেন। যাঁরা শোকপ্রস্তাবে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁরা কি ওই সুদীর্ঘ ষাট সেকেন্ড শুধু মৃতদের আত্মার শান্তির কথাই ভাবেন, না কি এ সব নেহাতই এক বিলিতি প্রথার অনুকরণ! আমার দৃঢ় ধারণা, ওই সময় অনেক সাহেবের মাথাতেও অনেক কুচিন্তা (অন্য যে-কোনও চিন্তাই কুচিন্তা) এসে যায়।
কলেজজীবন থেকেই আমি নাস্তিক। কী করে হলাম, তা জানি না। সম্ভবত ধর্মের নামে দাঙ্গা ও রক্তপাত দেখেই। সত্যি কথা বলতে কি, প্রত্যেকটা ধর্মই বেশ কিছুটা ভণ্ডামির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দুরা মূর্তি পুজো করে বলে খ্রিস্টানরা কত গালাগালি দিয়ে গেল, কিন্তু তারাও তো গির্জায় গিয়ে যিশু কিংবা মেরি-র মূর্তির সামনে মোমবাতি জ্বালায়, অনেকে সেখানে প্রার্থনা করে, কাঁদে। মূর্তিপূজার সঙ্গে এর কী তফাত? ইসলাম অতি উচ্চাঙ্গের ধর্ম, সেখানে কোনও মূর্তি কিংবা ছবিরও স্থান নেই। খ্রিস্টধর্মে যেমন যিশু-মেরি ছাড়াও অনেক সন্তের মূর্তি গির্জাগুলিতে শোভা পায় (ক্যাথলিকদের কথাই বলছি, পৃথিবীতে এখনও তাদেরই সংখ্যাধিক্য), ইসলামে স্বয়ং পয়গম্বর ছাড়া আর কোনও সন্ত নেই। আল্লা নিরাকার। আমার মাথায় অনেক দিন ধরেই একটা প্রশ্ন ঘোরে, বিশ্বের কোটি কোটি ইসলামধর্মী প্রার্থনার সময় কি শুধু সেই নিরাকারের কথাই কল্পনা করে? তাই যদি হয়, তবে তার জন্য কী দারুণ চিত্তশুদ্ধি দরকার!
আমার এক শুভার্থী বন্ধু এক বার বলেছিল, তুই খামোখা নাস্তিক হতে গেলি কেন? প্রত্যেক ধর্মেই কত উৎসব হয়, তুই কোনও উৎসবের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারিস না। নাস্তিকরা নিঃসঙ্গ। যেহেতু এটা কোনও ধর্ম নয়, তাই এদের মিলিত হওয়ার কোনও জায়গাও নেই।
আমি তাকে বলেছি, কোনও ধর্ম কিংবা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী না হয়েও, এবং জ্ঞানত কারও কোনও ক্ষতি না করেও তো পৌনে একটা শতাব্দীরও কিছু বেশি বছর তো দিব্যি কাটিয়ে গেলাম এই পৃথিবীতে। কোনও অসুবিধে তো হল না। অবিশ্বাসীদেরও পূর্ণ জীবন কাটাবার অধিকার আছে। আর অবিশ্বাসী হলেও উৎসবে যোগ দিতে তো কোনও বাধা নেই। ক্রিসমাসের সময় কত হুল্লোড়ে যোগ দিয়েছি এক সময়, একবার মধ্যরাতের পর সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম, কী সুন্দর ভাবগম্ভীর দৃশ্য দেখেছি। আর ঈদের সময় মুসলমান বন্ধুদের বাড়িতে গেছি বিরিয়ানি আস্বাদের লোভে। সবাইকে ঈদ মুবারক বলেছি। হিন্দুদের অনেক ধর্মীয় উৎসবে এখন ধর্ম প্রায় বিলীন হয়ে উৎসবটাই আসল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নিজেকে মিশিয়ে দিতে কোনও বাধা নেই তো?
আমার কোনও ধর্মেই বিশ্বাস নেই বলেই আমি অপর কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার কথা চিন্তাও করি না। ধর্মের ধ্বজাধারীরা যখন পারস্পরিক হানাহানিতে মেতে ওঠে, শিশুদেরও বাদ দেয় না, তখন যে ধর্মেরই হোক, নিহত জননী ও শিশুদের জন্য বড় কষ্ট হয়, বড় কষ্ট হয়। কোনও ধর্মেই এ রকম নির্দেশ নেই। অতি তুচ্ছ কারণে কিংবা জেদের বশে জীবনের এ কী অপচয়!
নাস্তিকেরা নিঃসঙ্গ শুধু নয়, তাদের নিজস্ব তেমন কোনও সাহিত্য নেই, সংগীত নেই। রাশিয়া কিংবা চিনের কথা জানি না, কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাসীরা কত উচ্চাঙ্গের সাহিত্য রচনা করেছেন, কত গান, সে সবই আমি উপভোগ করি। কোনও কোনও গান শুনতে শুনতে হঠাৎ আমার চোখে জল এসে যায়। তখন আমার স্ত্রী সকৌতুকে আমার দিকে তাকালে তাঁকে বলি, কান্নার মতন আনন্দের আর কী আছে, বলো!
অল্প বয়েসে মনে হত, পৃথিবীতে যদি একটা ধর্ম থাকত, যার নাম ভালবাসা, তা হলে তো এখানেই স্বর্গ রচিত হতে পারত। এখন মনে হয়, তা হলে ভালবাসার কতই না কদর্থ হত। যাক, ভালবাসা নিয়ে বেশি হইচই করার দরকার নেই। ভালবাসা যত নিভৃতে রাখা যায় ততই ভাল।
আমার বিজ্ঞান-জ্ঞান যৎসামান্য, তবে কৌতূহল অনন্ত। সহজ করে লেখা মহাকাশবিজ্ঞানের বইগুলি আগ্রহের সঙ্গে পড়ি। একটা মজার ব্যাপার এই যে, ইদানীং অনেক বিজ্ঞানীর বইয়ের নামেই ‘গড’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়। তাতে নাকি পাঠকদের কৌতূহল চাঙ্গা হয়, বই ভাল বিকোয়। আমার হাতের কাছেই দু’টি বই রয়েছে, রিচার্ড ডকিনস-এর ‘দ্য গড ডিলিউশন’ আর পল ডেভিস-এর ‘গড অ্যান্ড দ্য নিউ ফিজিক্স’। এমনকী হিক্স বোসন নামে অঙ্ক থেকে জাত যে কণিকাটির বাস্তব অস্তিত্ব আছে কি নেই, তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে, যেন মজা করেই তার নাম দেওয়া হয়েছে গড পার্টিকল! অনেক কাল আগে ব্রেখ্টের একটি ছোট কবিতা পড়েছিলাম। এটা একবার পড়লেই মুখস্থ হয়ে যায়
জানুয়ারি টেন
সিক্সটিন টেন
গালিলেয়ো গালিলি
অ্যাবলিশেস হেভেন! |
|
|
|
|
|