এ রাজ্যে চিকিৎসা পরিষেবার বেহাল অবস্থার একটি কারণ মানবসম্পদের সমস্যা। সম্প্রতি এই সমস্যার কয়েকটি দিক পরিলক্ষিত হইয়াছে। প্রথমত, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে শিক্ষক-ডাক্তার নির্ভর করিবার প্রস্তাব আনিয়াছে স্বাস্থ্য দফতর। এইমস-এর মতো পশ্চিমবঙ্গেও কেন শিক্ষক-চিকিৎসকরাই রোগী দেখার দায়িত্ব পালন করিবেন না, সেই প্রশ্ন উঠিয়াছে। স্বাস্থ্য দফতর প্রস্তাব করিয়াছে, রোগীর চাপ সামলাইতে জেলা হাসপাতালগুলিতে পাঠানো হইবে মেডিক্যাল অফিসারদের। দ্বিতীয়ত, তিন জন নার্সকে কর্তব্যে অবহেলার জন্য হুগলির একটি হাসপাতাল হইতে ঝাড়গ্রামের হাসপাতালে ‘শাস্তিমূলক’ বদলি করা হইয়াছে। তৃতীয়ত, কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক বিভাগে মায়েদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়া নার্সের কাজ চালানো হইতেছে। এই তিনটি সংবাদ একত্র করিলে স্বাস্থ্য দফতরের একটি মৌলিক সমস্যা চোখে পড়ে। তাহা হইল, চিকিৎসক-নার্সদের কাজের মূল্যায়ন, এবং তদনুসারে তাহাদের বদলি-উন্নতির নির্দিষ্ট নীতির অভাব। কোন চিকিৎসক কখন ‘যথেষ্ট’ কাজ করিতেছেন, কখন তাঁহার উপর অতিরিক্ত চাপ পড়িতেছে, তাহা স্পষ্ট নহে। ফলত, এক দিকে স্বাস্থ্য দফতর সর্বদাই চিকিৎসকদের সন্দেহ করিতেছে, অপর দিকে চিকিৎসকরা পরিকাঠামোর অভাবে প্রত্যাশিত পরিষেবা দিতে পারিতেছেন না বলিয়া দাবি করিতেছেন। মায়েদের প্রশিক্ষণ দিবার মতো নানা বিকল্পের অনুসন্ধান চলিতেছে। কার্যত উভয় পক্ষই চিকিৎসায় ‘যথাসাধ্য ভাল’ করিবার আশা ছাড়িয়া ‘মন্দের ভাল’ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন। ইহাই কি প্রত্যাশিত? রোগী পরিচর্যায় অপ্রশিক্ষিত, অপেশাদারদের প্রয়োগের অনুমতিপত্র দিয়া স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা দায় সারিবেন? চিকিৎসকরাই বা ‘পরিকাঠামোর অভাব’-এর দোহাই দিয়া কত দিন স্বমূল্যায়ন এড়াইবেন?
কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অতি-সংকটপূর্ণ রোগীদের যদি আত্মীয়দের দিয়া শুশ্রূষার ব্যবস্থা করিতে হয়, তবে জেলাগুলিতে কী হইবে? নবজাতকদের পরিচর্যায় নানা হাসপাতালে নার্সের পদ ফাঁকা রহিয়াছে, না যথেষ্ট পদ দেওয়া হয় নাই? অথবা, যথেষ্ট নার্স থাকা সত্ত্বেও তাঁহাদের ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে পাওয়া যাইতেছে না? এই সমস্যাগুলি ভিন্ন, তাহাদের প্রতিকারও আলাদা। সমস্যার উৎস নির্ণয় না করিয়া সুবিধা মতো কোনও একটি সমাধান করিলে বহু অর্থের অপচয় হইবে, কিন্তু কাজ হইবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, এই রাজ্যের অর্থভাণ্ডার হইতে বহু কোটি টাকা দিয়া সাফাই কর্মীদের বেতন চুকানো হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে হাসপাতালের জঞ্জাল কমে নাই। ইহার সমাধান আরও সাফাই কর্মী নহে, প্রয়োজন কাজ অনুসারে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা। যে কোনও প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের নিয়মিত মূল্যায়ন, ও তদনুসারে পুরস্কার ও শাস্তি কর্মসংস্কৃতির মূল কথা। কিন্তু এ রাজ্যের চিকিৎসা পরিষেবায় মূল্যায়নের স্বচ্ছতা নাই। পুরস্কার ও শাস্তির ধারণাও আপত্তিজনক। অনুন্নত জেলায় বদলি করিয়া নার্সদের ‘শাস্তি’ দিলে শাস্তি পাইবে সাধারণ রোগী। গাফিলতির জন্য অপর শাস্তি বিধেয়। অচিরে পেশাদারিত্বের বিচারে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের মূল্যায়ন, উৎসাহপ্রদান ও শাস্তিবিধানের ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। নচেৎ স্বাস্থ্য খাতে সরকারের সামান্য বরাদ্দ নষ্ট হইবে, দরিদ্র রোগীর কাজে আসিবে না। |