লোকপাল বিল লইয়া শোরগোল এমনই উচ্চগ্রামে উঠিয়াছে এবং এই বিষয়ে ভিন্নমতের বৈচিত্র এমনই জটিল আকার ধারণ করিয়াছে যে মূল প্রশ্নগুলি হারাইয়া ফেলিবার ঘোর আশঙ্কা। মূল প্রশ্ন দুইটি। এক, যে পদ্ধতিতে অণ্ণা হজারে ও তাঁহার অনুগামীরা তাঁহাদের প্রস্তাবিত জন লোকপালের ধারণাটি বলবৎ করিতে চাহেন, তাহা কি যথাযথ? দুই, লোকপাল নামক প্রতিষ্ঠানটি কি আদৌ আবশ্যক, এবং যদি আবশ্যক হয়, তবে তাহার কাঠামো, ক্ষমতা এবং কর্মপদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত? প্রথম প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট। গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিক সমাজের একটি অংশ কোনও একটি বিষয়ে সরকারের সহিত ভিন্নমত পোষণ করিলে বা আপন মতের পক্ষে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করিলে আপত্তির কোনও প্রশ্ন নাই। অণ্ণা হজারের আন্দোলনে দেশের কয়েকটি অঞ্চলের কয়েকটি শহরের কয়েকটি বর্গের নাগরিক যোগ দিয়াছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসী তাহাতে যোগ দেয় নাই ইহাতেও বিসদৃশ কিছু নাই, বহু আন্দোলনের পরিধিই এমন আংশিক এবং সীমিত হইয়া থাকে। কিন্তু এই আন্দোলনের নায়করা যে ভাবে নির্বাচিত সরকারের, এমনকী সংসদের মর্যাদাকেও সম্পূর্ণ তুচ্ছ করিয়া অনশন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারকে চাপ দিয়া চলিয়াছেন, তাঁহাদের প্রস্তাবটিই মানিতে হইবে বলিয়া জোর করিতেছেন, তাহা কেবল অগণতান্ত্রিক নয়, অনৈতিক। গণতন্ত্র ভিন্নমত পোষণের অধিকার দেয়, এবং সেই কারণেই গণতন্ত্রে পরমতসহিষ্ণুতা অত্যন্ত জরুরি। সচরাচর রাষ্ট্রকে পরমতসহিষ্ণু হইবার উপদেশ দেওয়া হয়, দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তথাকথিত নাগরিক সমাজের আচরণেও সহিষ্ণুতা কম জরুরি নয়। তাহার অভাবে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহার ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে বিভিন্ন মত শোনা যাইতেছে, লোকপালের গঠন এবং পরিচালনা সম্পর্কে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মত, এমনকী একই দলের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিভিন্ন মতও উপস্থিত। কিন্তু লোকপালের যে প্রয়োজন আছে, তাহা মোটের উপর সব দলই মানিয়া লইয়াছে। কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রী জানাইয়াছেন, তাঁহাদের সরকার ‘চাপে পড়িয়া’ লোকপাল বিল আনে নাই, তাঁহারা মনে করেন, লোকপাল গঠনের ‘সময় আসিয়াছে’। সত্যই সময় আসিয়াছে? লোকপালের কি সত্যই কোনও প্রয়োজন আছে? দেশের প্রচলিত আইনে প্রশাসন কেন দুর্নীতির অনুসন্ধান করিতে পারিবে না, আদালত কেন তাহার বিচার করিতে পারিবে না? মন্ত্রী এবং সরকারি কর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিচারের জন্য লোকপাল নামক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হইবে কেন? সচরাচর ইহার উত্তরে যুক্তি দেওয়া হয় যে, প্রচলিত বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে এই ধরনের অভিযোগের মোকাবিলা করিতে অনেক বিলম্ব ঘটে, অন্য নানা বাস্তব সমস্যাও দেখা দেয়। পাশাপাশি প্রশাসনের কর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করিতে সি বি আইয়ের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান অনেক সময়েই প্রত্যাশিত তৎপরতা দেখায় না বা তাহাকে সেই তৎপরতা দেখাইতে দেওয়া হয় না, এমন অভিযোগও প্রবল। কিন্তু কোনও প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা ভাল কাজ না করিলে তাহার কাজ কী ভাবে ভাল হইতে পারে, তাহার উপায় খোঁজা দরকার, আর একটি নূতন প্রতিষ্ঠান তৈয়ারি করিলেই সমস্যা মিটিয়া যাইবে, তাহা কে বলিল? ভারতে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোটি রীতিমত সবল, সুবিন্যস্ত। দীর্ঘ কাল যাবৎ প্রতিষ্ঠানগুলি কাজ করিতেছে। সেগুলিকে কী ভাবে আরও শক্তিশালী, নিরপেক্ষ এবং বিশ্বাসযোগ্য করিয়া তোলা যায়, তাহাই ভারতীয় গণতন্ত্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত। লোকপাল নামক সর্বরোগহর বিশল্যকরণীর সন্ধানে বিস্তর সময় নষ্ট হইতেছে, ইহাই প্রকৃত দুর্ভাগ্য। |