অসি যুদ্ধি
উন্মাদনা এড়িয়ে পরিশ্রমই সচিনের সান্তা
স্ট্রেলিয়ায় গত দশ বছরে ভারতের সেরা রফতানিজাত পণ্য কী? যদি বলেন, চা এবং একগুচ্ছ তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদার, দশে বড়জোর দুই পাবেন।
ঠিক উত্তর সচিন তেন্ডুলকর এবং চিকেন বাটার মশলা।
চার বছর আগে সাইমন্ডস বনাম হরভজনে কলঙ্কিত ভারতের শেষ অস্ট্রেলিয়া সফরেও এ দেশের জনজীবনে ভারতীয় রান্নাবান্নার এত প্রভাব ছিল না, এ বারে এসে যা দেখছি। ডাউনটাউন মেলবোর্নে একটু পর পর ভারতীয় রেস্তোরাঁ। ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট যাকে এখানকার ক্যামাক স্ট্রিট বলা যায়, সেখানে নতুন ধাবা খুলেছে। রেস্তোরাঁ ছেড়েই দিলাম। বড় এবং মাঝারি হোটেলগুলোতেও এখন শেফ-দের ভারতীয় রান্না জানতেই হবে। যেখানে একটা ডিশ অনিবার্য চিকেন বাটার মশলা!
তেন্ডুলকর অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায় বিরানব্বইয়ের সেই প্রথম সফর থেকেই সবার মেনুতে। এ বারও তাঁকে ঘিরে টেস্ট সিরিজ যেমন সরগরম, তাতে আশঙ্কা হচ্ছে। এর পরের অস্ট্রেলিয়া সফর যখনই হোক, নিশ্চিত ভাবেই তিনি তো তখন আসবেন না। কে আসবে সেই সময় ভারতকে দেখতে? গড়পড়তা অস্ট্রেলীয়র মনোভাব এ বার যেন আরও সাফ তেন্ডুলকর এবং দশ জন বিদেশি নিয়ে সফরকারী ভারত!
ইয়ারা নদীর ধারে কুইন্স ব্রিজ স্কোয়ারে এ দিন দুপুরে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাদের স্পনসর ভোডাফোনের অনুষ্ঠানে ভক্তদের সঙ্গে দু’দলের বারো জন ক্রিকেটারের খোলাখুলি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিল। ভারতে হলে অনুষ্ঠানটা করাই যেত না। মেট্রোর উল্টো দিকে ধর্না মঞ্চের ওপর পন্টিং, ক্লার্ক, দ্রাবিড়, জাহির, কোহলি, হাসি বাচ্চাদের সঙ্গে প্লাস্টিক বলে ক্রিকেট খেলছেন। মাইকে বলছেন। কোনও দিন সুশৃঙ্খল ভাবে করা যায় নাকি! এখানে হল তো ঠিকই, আর জনতা টানা চেঁচিয়ে গেল স্যা-চি-ন, স্যা-চি-ন। একটা সময় মিডিয়ার লোকেরা তো অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। তা হলে কি সচিন ভেতরে এমন কোথাও আছেন, যেখানে আমদর্শক দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তাঁদের নজরে আসছে না।
মেলবোর্নে অনুশীলনের ফাঁকে সচিন। ছবি: এ পি
ঘণ্টাখানেক পরে আবিষ্কৃত হল, সচিন সেখানেই আছেন যেখানে তাঁর পড়ে থাকার কথা! এমসিজি-র ইন্ডোর নেটে! ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বোলিং মেশিনের সামনে। সেই একই থিম আমি, ক্রিকেট ব্যাট, অনুশীলন এবং অনন্ত। ইয়ান চ্যাপেল সম্প্রতি এমন অনুশীলন পদ্ধতির সমালোচনায় বলেছেন, “এত বেশি রগড়ানির কোনও প্রয়োজন নেই। ব্র্যাডম্যান থেকে লারা কেউ করেনি। সচিন যেটা করছে, বাড়াবাড়ি।” মনে হল না তাতে তেন্ডুলকরের ক্রিকেট আরাধনা কোনও ভাবে প্রভাবিত হয়েছে বলে! তাঁর গোটা পরিবার এখন মেলবোর্নে। সঙ্গে শাশুড়িও। কিন্তু বললেন, “কী করে ওদের সময় দেব বুঝতে পারছি না। পুরো সময়টাই তো প্রস্তুতিতে চলে যাচ্ছে।”
ছেলে অর্জুন অবশ্য বাবার সঙ্গেই নেটে ঘুরছে। সহবাগকে অনেক ক্ষণ বল করল। ইন্ডোর নেটে বাবার বলে ব্যাট করছিল। বাইরের প্র্যাক্টিস এরিনায় গোটা ভারতীয় দল। কিন্তু অস্ট্রেলীয় মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল পিতা-পুত্রের অনুশীলনে। মুম্বইয়ে কমবয়সিদের স্থানীয় ক্রিকেটে এখন সাড়া ফেলে দিয়েছে অর্জুন। এক দিন ছয় উইকেট নেওয়া ছাড়াও ঝোড়ো সেঞ্চুরি করেছে। হপ্তাখানেক আগেই মুম্বইতে বাড়ি ফিরে উত্তেজিত ভাবে বাবাকে বলেছে, “কী সেঞ্চুরি করে এলাম জান? উনিশটা বাউন্ডারি। তিনটে ওভার বাউন্ডারি।” সচিন তখন শান্ত ভাবে বলেন, “ভাল কথা। কিন্তু আমার কাছে জরুরি হল, ক’টা বল তুমি ঠিকঠাক টাইম করেছ গোটা ইনিংসে?” অর্জুন বলে, “কী বলছ, ৯২ থেকে ছয় মেরে ৯৮। তার পর বাউন্ডারি মেরে সেঞ্চুরি করলাম।” সচিন এ বার হেসে ফেলেন। যদিও অর্জুনের ক্রিকেট নিয়ে মিডিয়ায় কিছু বার হোক, তিনি একেবারেই চান না। পরিবারবর্গকে অবধি বলে রেখেছেন কেউ যেন কোথাও মুখ না খোলে। এ দিনও অর্জুনের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের কথা জিজ্ঞেস করায় বললেন, “ওর ইনিংসের চার-ছক্কাগুলোর কথা অর্জুনের মুখে শোনেননি তো!”
সব সময় বিনীত থেকে ক্রিকেটদেবতার পুজো করো। একমাত্র তা হলেই দেবতার বরপ্রাপ্ত হবে।
বরাবরের এই মডেল থেকে তিনি আজও বিচ্যুত নন। মেলবোর্নের সব বড় বড় রাস্তা দিয়ে এ দিন বেশ কিছু সান্তাক্লজ রূপে সজ্জিত মানুষ যেতে দেখলাম। এই সপ্তাহের জনপ্রিয় পেশা। এঁরা মেকআপ এবং উপহার নিয়ে বিভিন্ন বাড়ি আর হোটেলে যান। শুক্রবারের সচিনকে দেখে মনে হল, শততম সেঞ্চুরির জন্য যতই সবাই বলুক ভাগ্যের হালকা আশীর্বাদ চাই। তিনি সাজানো সান্তাক্লজ চান না। কঠোর পরিশ্রম তাঁর বরাবরের সান্তা! এ বারেও। বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচ শুরুর তিন দিন আগেই গোটা অস্ট্রেলিয়া যে ভাবে তাঁর সম্ভাব্য কীর্তি নিয়ে হল্লা ফেলে দিয়েছে, তাতে অনন্ত পরিশ্রমকে সান্তা করা ছাড়া হয়তো উপায়ও নেই। অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম খুঁজে খুঁজে এখন বার করেছে সেই পেসারকে, যিনি বিরানব্বইয়ের সফরে, তেন্ডুলকরকে অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর উদ্বোধনী ম্যাচে প্রথম ডেলিভারিটা করেছিলেন। ম্যাচটা ছিল অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের বিরুদ্ধে। তেন্ডুলকর করেন ২৪। বিপক্ষে ছিলেন বিয়াল্লিশ বছরের ডেনিস লিলি। সেই সফর সচিন শেষ করেন ৪৬ গড় নিয়ে। পরের বার অধিনায়ক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট গড় ছিল আবার ৪৬। ২০০৩-০৪-এ যখন সৌরভ অধিনায়ক, তখন তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬.৬। কুম্বলের নেতৃত্বে শেষ সফরে ছিল ৭০। এ বারে কত হবে, ইতিমধ্যে গবেষণা শুরু হয়ে গিয়েছে। যা শিবাজি পার্কে বসে অন্ধ তেন্ডুলকর-ভক্তও ভাবছে বলে মনে হয় না।
সাধনা শেষে। এম সি জি থেকে বেরোচ্ছেন সচিন। ছবি: গেটি ইমেজেস
ডিন জোন্স এ দিন নেটে ভারতীয়দের অনুশীলন দেখতে এসেছিলেন। যাওয়ার আগে আনন্দবাজারে পূর্বাভাস করলেন, টেস্ট ম্যাচ ড্র হচ্ছে। এর পর বললেন, “আমায় প্রশ্ন করুন আমার শুকনো মুখচোখের ব্যাখ্যা কী?” নিজেই উত্তর দিলেন, “মেলবোর্নের নামী খবরের কাগজ বলেছে সচিন তেন্ডুলকরকে কী ভাবে আউট করা যায়, সেই ছকের পরামর্শ দিতে।” তা তিনি কী লিখবেন? উত্তরে ডিন জোন্স বললেন, “এক-আধ বার আমি ওকে দেখেছি বটে অফ স্টাম্পের বেশ কিছুটা বাইরের বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে একটু উঁচুতে খেলতে। কিন্তু এর বেশি আমি কী বলতে পারি? মোনালিসার পেন্টিংয়ে কী খুঁত আছে কেউ বলতে পারে?” জোন্স বললেন, “বরঞ্চ আমি লিখব, ওকে কেউ স্লেজ কোরো না। কড়া চোখে তাকিও না। তা হলে আরও গ্যাছো। বরঞ্চ আউট করা অসম্ভব মনে হচ্ছে দেখলে মন দিয়ে ওর ব্যাটিংটা দেখো। এই সফরের পর আর তো ওকে দেখতে পাবে না।”
বহু আলোচিত তেন্ডুলকরের সম্ভাব্য শততম নিয়ে জুয়াড়িদের সার্কিটেও এমন ‘হাইপ’ যে শুধুমাত্র এর ওপর বাজির দর ফেলা হয়েছে। গরিষ্ঠ মত, মেলবোর্নেই সেঞ্চুরি হয়ে যাবে। আপাতত ১ অস্ট্রেলীয় ডলার বাজি রাখলে পাওয়া যাবে ৩.২৫ ডলার। সিডনি টেস্টে সেঞ্চুরিটা হলে ৪.২৫ ডলার। পারথে হলে ৫.৫০ ডলার। আর অ্যাডিলেড টেস্টে ঘটলে ডলারপিছু ৭ ডলার। অর্থাৎ জুয়াড়িদের ধারণা, কীর্তিটা অ্যাডিলেড অবধি অপেক্ষা করবে না।
টেস্ট সেঞ্চুরি নিয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা জনপ্রিয় মন্তব্য আছে যে, সেঞ্চুরি মানে কলেজ স্ট্রিট থেকে সত্যজিৎ রায়ের বই কিনে ফেরা নয়। কিন্তু সিরিজ শুরুর তিন দিন আগেই অস্ট্রেলিয়ার যা মেজাজ, ও সব যুক্তিটুক্তি ইয়ারার জলে ভাসছে। কুইন্সল্যান্ডের গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক দাবি করেছেন, তাঁর প্রচলিত র্যাঙ্কিং পদ্ধতি অনুযায়ী তেন্ডুলকর ছাপিয়ে গিয়েছেন ব্র্যাডম্যানকে। নিকোলাস রোড নামের ওই গবেষক বলছেন, “দেখতে হবে গ্রেট প্লেয়ার মোট তার কেরিয়ারে কত করেছে। আর সেই আমলের গড়পড়তা প্লেয়ার সমসংখ্যক ইনিংস খেলে কত করত। দু’টোর মধ্যে বিয়োগ করলে ওটাই গ্রেটের নিট স্কোর।”
ডন ৫২ টেস্টে তাঁর আমলের গড়পড়তা ক্রিকেটারের চেয়ে ৪ হাজার রান বেশি করেছেন। সচিন সেখানে করেছেন ৪১০০ রান বেশি। তাই সচিন আগে।
খোদ অস্ট্রেলিয়াবাসী টেস্টের বল মাঠে পড়ার আগে ব্র্যাডম্যান সরিয়ে সচিনকে আগে বসাচ্ছে। শততমটা চলতি সিরিজে হয়ে গেলে কী হবে, কে জানে!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.