চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
সন্ধান মেলে স্বাতন্ত্র্য, সারল্য এবং অন্তর্মুখীনতার
পঁচাত্তর বছরের পরিপূর্ণ জীবনের উদ্বেল যাত্রাপথকে মেলে ধরলেন শিল্পী ধীরাজ চৌধুরী অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে তাঁর অজস্র বন্ধু ও সহযোগী শিল্পীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় দীপ্ত পুষ্পাঞ্জলিতে। অর্ধ শতকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর যে নিরন্তর নন্দনযাত্রা তাঁর ভিতর থেকে শিল্পীর নিজেরই নির্বাচিত ছবি ও ভাস্কর্যের সম্ভার নিয়ে অনুষ্ঠিত হল প্রদর্শনীটি। সঙ্গে ছিল তাঁর সহযোগী শিল্পীদের সঙ্গত। এর আগে একটি কর্মশালায় ৭৫ জন শিল্পী ছবি এঁকেছেন ধীরাজের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীকে উদ্বোধিত করতে। সে সব ছবি এবং ভাস্কর্যও দেখানো হল প্রদর্শনীতে।
১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের অন্যতম এক জন প্রতিনিধি ধীরাজ চৌধুরী। স্বদেশ ও বিশ্বের সমন্বয়চেতনাকে গ্রথিত করে দেশ-কালের সংক্ষুব্ধ আন্দোলনকে আত্মস্থ করে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন আধুনিকতাবাদী চেতনায় গ্রথিত রূপকল্প। সেখানে এই শিল্পীর অবদানও খুবই আলোকোজ্জ্বল। সৌন্দর্য ও সংঘাতের সমন্বয়ী ও দ্বান্দ্বিক অভিঘাতে গড়ে উঠেছে তাঁর নিজস্ব রূপকল্প। বিশেষ একটি রূপভঙ্গি তিনি গড়ে তুলেছেন ধীরে ধীরে, যাতে রয়েছে তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর ১৯৬০-এর দশক ছিল তাঁর অনুশীলনের সময়কাল। এখানকার শিক্ষা শেষ করে দিল্লি আর্ট কলেজে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘ দিন। বাংলার সজল প্রকৃতির ভিতর থেকে তিনি পেয়েছেন চলার পথের উদ্দীপিত আলো।
শিল্পী: ধীরাজ চৌধুরী
দিল্লিতে গিয়ে দেশের বৃহত্তর পরিমণ্ডল ও বিশ্ব উন্মোচিত হয়েছে তাঁর সামনে। স্বাধীনতার আলো ও অন্ধকার দেখেছেন। রয়েছে চল্লিশের দশকের নানা সামাজিক সংঘাত ও বিপর্যয়ের স্মৃতি। তারপর উত্তর ঔপনিবেশিক পর্বে দেশগঠনের সাফল্য ও ব্যর্থতা- এ সবই কাজ করেছে তাঁর শিল্পীচেতনার উন্মেষে। অত্যন্ত সমাজসচেতন ও দায়বোধে দীপ্ত শিল্পী ধীরাজ। তাই প্রতিবাদীচেতনা তাঁর প্রকাশের একটি বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি এই অন্ধকারের ভিতরই আলো খুঁজেছেন। পেয়েছেনও প্রকৃতির নিবিড় সৌন্দর্যে, মানবিক মহত্বের নানা উন্মোচনে। এই দু’টি দিকের দ্বান্দ্বিক সংশ্লেষের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর ছবি ও ভাস্কর্য।
দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে ২০০৬ সালে আঁকা তাঁর একটি ছবি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি লাইন এই ছবির শিরোনাম - ‘তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ? তুমি কি বেসেছ ভাল?’ শেষ অংশটি হয়েছে শিরোনাম। ‘ক্যান ইট বি দ্যাট ইউ লাভ দেম?’ নিবিড় রক্তিম প্রেক্ষাপটে দুই কৃষ্ণকায় পশুর সংঘাত এই ছবির প্রধান উপজীব্য। তাদের মাথাগুলি সবুজ। তাঁরা নখদন্ত বিস্তার করে পরস্পরকে হননে উদ্যত। একপাশে রয়েছে কয়েকটি সবুজ পাখি, শকুনের মতো। মাঝখানে শুভ্র রেখায় আঁকা বংশীবদনরত এক জন মানুষ, সম্ভবত শ্রীকৃষ্ণের অনুষঙ্গবাহী। পাশে একটি প্রস্ফুটিত ফুল। এই ছবিতে কৃষ্ণানুষঙ্গের প্রতিমায় তার রূপবিন্যাসের যে ধরন, শীর্ণ দীর্ঘায়ত উপস্থাপনা, অনেকটা যেন আলোর অভীপ্সা মাখা। সেটাই তাঁর নিজস্ব রূপবিন্যাসের স্মারক হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে।
২০০৫-এর ‘বনলতা সেন’ ছবিতে যে নারীর উপস্থাপনা দেখি আমরা, সেই শীর্ণ দীর্ঘায়ত রূপায়ণে নারীর রহস্যকে উন্মীলিত করেন তিনি। ছবির ভিতর অনেক সময়ই কবিতাকে উৎকীর্ণ করে তোলেন। এই ছবিতে যেমন লেখা দেখতে পাই - ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার...’ বা ‘আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। এই ক্যালিগ্রাফি তাঁর রেখার বিন্যাসের সাযুজ্যে করা। কবিতার ভিতর দিয়ে জীবনকে বুঝতে চাওয়া তাঁর ছবির একটি বৈশিষ্ট্য। তাঁর ছবি সাধারণকে ছুঁতে পারে সহজে।
কাঠের রিলিফে ও ব্রোঞ্জে যে ভাস্কর্যগুলো তিনি করেছেন, সেগুলি আদিমতার অনুষঙ্গবাহী। লৌকিক সারল্য ও অভিব্যক্তিবাদী অন্তর্মুখীনতার ঋদ্ধ মেলবন্ধন ঘটেছে তাতে। ২০০৯-এর ব্রোঞ্জ ‘দ্য লিডার’, ২০১০-এর ‘দ্য কিং’, ২০১১-র ‘দ্য হেড’, ‘দ্য ফেসেজ’ বা ‘অ্যাগনি’ - সবই মনুষ্য অবয়ব ও মুখাবয়বভিত্তিক বিভিন্ন রচনা। ফর্ম নিয়ে কোনও জটিলতার দিকে না গিয়ে সহজ বিন্যাসে রূপের অন্তস্তলে পৌঁছাতে পারাই তাঁর ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য। তাঁর ছবির রূপবিন্যাসের সঙ্গে এর সাযুজ্য আছে, আবার স্বাতন্ত্র্যও আছে। এই স্বাতন্ত্র্যের জন্যই বিশিষ্ট ভাস্কর হিসেবে তাঁকে চিনে নেওয়া যায় এবারের এই প্রদর্শনীর নিরিখে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.