|
|
|
|
সিপিএমের ‘দাদাগিরি’র অবসান চায় সিপিআই |
প্রসূন আচার্য • কলকাতা |
বামফ্রন্টে সিপিএমের ‘দাদাগিরি’ অবসানের দাবি তুলল ফ্রন্টের অন্যতম শরিক সিপিআই। তাদের সরাসরি অভিমত, আলিমুদ্দিন থেকে বামফ্রন্টের অফিস সরিয়ে নিতে হবে।
২৫ ডিসেম্বর শিলিগুড়িতে সিপিআইয়ের রাজ্য সম্মেলন শুরু। সেই সম্মেলনেরই রাজনৈতিক খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সমস্ত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে, সমমর্যাদা ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক ভাবে পরিচালনার জন্য আচরণবিধি এমন ভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে বামফ্রন্ট কোনও শরিক দলের কুক্ষিগত বা সমর্থক না হয়ে পড়ে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে পেতে পারে’। ওই সম্মেলনে সিপিএমের ‘একচ্ছত্র প্রভাব’ থেকে বামফ্রন্টকে বার করে আনার ব্যাপারে আলোচনা হবে। সেই সূত্রেই খসড়া প্রতিবেদনে বামফ্রন্টের নিজস্ব দফতর এবং ফ্রন্টের এক জন বা যুগ্ম আহ্বায়কের কথা বলা হয়েছে। শরিক দলের যিনি ‘আহ্বায়ক’ হবেন, তাঁর দলীয় অফিসকে বামফ্রন্টের অফিস হিসাবে ব্যবহারের দাবি করেছে সিপিআই।
ভোটে ভরাডুবির পর বামেদের শরিক দলের এই ভূমিকা যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। আগে অনেক বারই বিভিন্ন প্রসঙ্গে শরিকরা সিপিএমের ‘দাদাগিরি’ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে। কিন্তু এ ভাবে বড় শরিককে ‘কোনঠাসা’ করার প্রয়াস দেখা যায়নি। শরিকদের বক্তব্য ছিল, প্রয়াত জ্যোতি বসুর আমলে শরিকরা অনেক বেশি ‘মর্যাদা’ পেত। বসুর উল্লেখ করেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এটা দেখা গিয়েছে, জ্যোতিবাবুর বক্তব্যও বামফ্রন্টের প্রধান শরিকের কাছে তেমন আমল পায়নি’। গত রাজ্য সম্মেলনের রিপোর্ট থেকে জ্যোতিবাবুকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, তিনি বলেছিলেন, ‘বামফ্রন্ট কোনও একটি দলের নয়। বামফ্রন্ট আছে বলেই আমরা আছি। একক ভাবে আমরা কেউ দাঁড়াতে পারব না।’।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এ কথাও বলা হয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে তাঁর আপত্তি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখা ইত্যাদি বিষয়ে মমতার ভূমিকাকে কেউ কেউ ‘বামপন্থী’ বলে গণ্য করেন! অর্থাৎ, বামপন্থীদের যা ‘করণীয়’, তা আসলে করছেন মমতা।
সিঙ্গুরে মমতা-সরকারের ভূমিকারও পক্ষান্তরে ‘প্রশংসা’ই করেছে ফ্রন্টের এই শরিক। প্রতিবেদনের ৩১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘মামলার (সিঙ্গুর) রায় কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সে সম্পর্কে আগাম কিছু বলা সম্ভব নয়। উচিতও নয়। তবে এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত দেওয়ার পক্ষে কারা আর বিপক্ষেই বা কারা, এই প্রশ্নই হল প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নে সরকার মামলায় হেরে গেলেও প্রমাণ হবে যে, সরকার কৃষকদের পক্ষে। টাটার পক্ষে নয়। বামফ্রন্টের আমলে বলা হয়েছিল, অধিগৃহীত জমি ফেরত দেওয়াই যায় না। কিন্তু দেওয়া যে যায় ইচ্ছা থাকলে নিদেনপক্ষে কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে চেষ্টা যে করা যায়, সেটাই কিন্তু এখন প্রমাণিত হল।’।
নাম না-করলেও সিপিআইয়ের লক্ষ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন, যাঁরা বার বার বলেছিলেন, অধিগৃহীত জমি ফেরত দেওয়া যায় না। কৃষ্ণনগরের বিগত সম্মেলনেই সিপিআই বলেছিল, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে যে পথ সরকার অনুসরণ করেছে, তা ভ্রান্ত। এই প্রতিবেদনেও সে কথা উল্লেখ করে সিপিআইয়ের দাবি, তাদের মূল্যায়ন সঠিক ছিল। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ও তাঁর সরকারের কাজের সমালোচনা করেও বলা হয়েছে, ‘বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের গভীরতা এত ব্যাপক যে বর্তমান সরকারের নানা পদক্ষেপ ও কাজকর্মের ফলে জনমনে ক্ষোভ-বিক্ষোভের যে প্রকাশ ঘটা স্বাভাবিক ছিল, তা প্রতিফলিত হচ্ছে না।’
রাজ্য সম্মেলনে ‘উন্নত বামফ্রন্টে’র দাবিতে একটি দলিল পেশ করবে সিপিআই। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট তৈরির পর থেকে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান হয়েছেন সিপিএমের নেতারাই। প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে বিমান বসু পর্যন্ত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকরাই ওই পদে থেকেছেন। সেই পদ্ধতির অবসান চেয়েই শরিক দলের থেকে এক বা যুগ্ম আহ্বায়কের দাবি তুলেছে সিপিআই। ওই আহ্বায়করা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শরিক দলের মধ্যে থেকে মনোনীত হবেন। সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মঞ্জুকুমার মজুমদারের কথায়, “প্রথম বা দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের আমলে বামফ্রন্টের আহ্বায়ক (তখন ‘আহ্বায়ক’ ছিলেন। ‘চেয়ারম্যান’ নন) সিপিএম থেকে হননি। ছোট দল আরএসপি এবং বলশেভিক পার্টি থেকে হয়েছিলেন।”
এ বারের সম্মেলনের পরে মঞ্জুবাবু রাজ্য সম্পাদকের পদ থেকে সরে যাবেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মঞ্জুবাবু নিজে নতুন মুখের পক্ষে। দৌড়ে সামনের সারিতে রয়েছেন স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্জুবাবু জানান, চার জেলা সম্পাদককে বদলানো হয়েছে, যাঁদের গড় বয়স ৫৫ থেকে ৬২-র মধ্যে।
অর্থাৎ তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা সিপিএমের থেকে ‘দুর্বল’ হলেও ‘বৃদ্ধতন্ত্রের’ অবসানে পিছপা নন। |
|
|
|
|
|