গুপ্ত যুগের স্থাপত্যের ইট চুরি রাক্ষসীডাঙায়
দেড় হাজার বছর আগের ইট দিয়ে কলতলার চারপাশ ঘেরা হচ্ছে। ভরাট করা হচ্ছে রান্নাঘরের নীচু জায়গা।
মুর্শিদাবাদের রাক্ষসীডাঙায় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের স্থাপত্যকীর্তির গা থেকে ওই ইটগুলি খুলে নেওয়ার ফলে স্থাপত্যটির আকারও বদলে যাচ্ছে। কিন্তু এলাকাটি ঘিরে ফেলাও যাচ্ছে না জমি নিয়ে বিতর্কের কারণে। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সেই ১৯২৮-২৯ সাল থেকে এই এলাকায় সমীক্ষা চালিয়েছে। তবে এতদিনেও এলাকাটি সংরক্ষণের জন্য সে ভাবে কিছুই করা হয়নি। সর্বেক্ষণের (কলকাতা মণ্ডল) অধিকর্তা তপনজ্যোতি বৈদ্য বলেন, “রাক্ষসীডাঙার ওই ঢিবিটি ১০০ মিটার বাই ৮০ মিটার জায়গা জুড়ে। তার চারপাশে আমরা পাঁচিল বা কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ওই জমির কিছুটা অংশ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। তাই বেড়া দেওয়ার কাজ করা যায়নি।” তাঁর বক্তব্য, “সেই সঙ্গে অর্থ সঙ্কটও ছিল।”
ইট খুলে নেওয়ায় আকারও পাল্টাচ্ছে স্থাপত্যের। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
মাত্র বছর খানেক আগেও পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ও রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর যৌথ ভাবে বহরমপুরের রাক্ষসীডাঙা ঢিপি উৎখনন করে। উৎখননের ফলে চিহ্নিত করা গিয়েছে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের ইঁটের স্থাপত্য। তার ঘর ও প্রবেশ দ্বার পাওয়া যায়, যা গুপ্ত যুগের শেষ পর্যায়ের ও শশাঙ্কের আমলের সূচনা কালের। এ ছাড়াও পোড়া মাটির বেশ কিছু প্রত্নসামগ্রী পাওয়া যায়। তার মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির তিনটি মস্তকও। এর পরেই ইতিহাসের দলিল হিসেবে ওই রাক্ষসীডাঙাকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তরফে বোর্ডও ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সব সময়ের জন্য দু’জন নিরাপত্তারক্ষীও রয়েছেন, তবু সপ্তাহ দু’য়েক আগে ওই বোর্ডটি দুষ্কৃতীরা মাটি খুঁড়ে উপড়ে ফেলে রেখে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা মানিক দে তা তুলে নিজের বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরেই এএসআই-এর কর্তারা লালবাগ থেকে গিয়ে সোমবার ওই বোর্ড নতুন করে লাগানোর বন্দোবস্ত করেন। স্থানীয় বাসিন্দা কুশকুমার দাসের অভিযোগ, “নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন, কিন্তু তাঁদের এলাকায় দেখা পাওয়া যায় না। এদিকে সচেতনতার অভাবে গ্রামবাসীরা ওই এলাকা থেকে একের পর এক ইঁট খুলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। সেই ইট কখনও রান্নাঘর বা কলতলার নীচু জায়গা ভরাট করার কাজে লাগছে।” রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের সহ-অধিকর্তা অমল রায় বলেন, “গুপ্তযুগের শেষ পর্যায়ের ইট অপেক্ষাকৃত বড় এবং সুন্দর ভাবে পোড়ানো, শশাঙ্কের আমলে বা সপ্তম শতাব্দীর ইট অপেক্ষাকৃত ছোট আর পাল-সেন যুগের ইট আরও ছোট।” তাঁর কথায়, “২০০৯-১০ সালে এএসআই এবং রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর যৌথ ভাবে খনন কার্য চালিয়ে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের ইটের স্থাপত্য ঘর ও প্রবেশ দ্বার চিহ্নিত করা গিয়েছে, যা গুপ্ত যুগের শেষ দিকের এবং শশাঙ্কের সময় কালের। মূল কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে ওই স্থাপত্য পরিবধর্র্ন বা পরিমার্জন করার ফলে তিন ধরনের ইটই সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। এখন ওই ইট খুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেই আমলের ইতিহাসের উপাদান হারিয়ে যাবে। ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়ন হবে না। অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”
১৯২৮-২৯ সালে ওই রাক্ষসীডাঙায় এএসআই-এর কে এন দীক্ষিত পরীক্ষামূলক উৎখননের কাজ করেছিলেন। সব থেকে নীচের ধ্বংসাবশেষটি ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত একটি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু এটিই যে কর্ণসুবর্ণ বিহার, সে বিষয়ে নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি। ঢিবিটি চারদিকের শস্যখেতের থেকে ২৫ ফুট উঁচু। অমলবাবু বলেন, “ঢিবি দেখে চতুষ্কোণ বা বর্গাকার স্থাপত্যের নির্দশন পাওয়া যাবে, এই অনুমানের ভিত্তিতে প্রথম বার উৎখনন কার্য চালানো হয়। তাতে ইটের স্থাপত্যের দক্ষিণ দিকের প্রায় পুরো দেওয়াল চিহ্নিত বা উন্মোচিত হয়েছে।”
ইতিহাস গবেষক বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরে ইট খুলে নিয়ে যাওয়ায় ওই এলাকার ইতিহাসের উপাদান এখন সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। গর্তগুলো আবর্জনা দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়েছে। তার পাশেই আবার নতুন গর্ত করা হয়েছে। এ থেকে অবশ্য নিচের দেওয়ালের সুনিশ্চিত অবস্থান বোঝা যায়। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সৌধটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে উপর থেকে ৯-১৩ ফুট নিচে। ইটগুলির আয়তন ১৫ ইঞ্চি বাই ১০ ইঞ্চি বাই ২ ইঞ্চি। এগুলি নিশ্চিত ভাবেই ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শতাব্দীর।”হাওড়া নরসিংহদত্ত কলেজের নৃতত্ব বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ২০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে ৩ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা মুর্শিদাবাদে আসেন। গত শনিবার তাঁরা রাক্ষসীডাঙায় যান। এর পরেই বিষয়টি নজরে আসে। নৃতত্ব বিভাগের অধ্যাপিকা জয়িতা রায় বলেন, “প্রত্নস্থল সংরক্ষণে আরও যত্নবান হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। রাক্ষসীডাঙায় গিয়ে আবিষ্কারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার আনন্দের চেয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি বলে যন্ত্রণা পেয়েছি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.