|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
আইস, আমরা কমার্শিয়াল হই |
বিভাস চক্রবর্তী |
সদ্য-সমাপ্ত নাট্যমেলা নিয়েই লেখাটি শুরু করি। রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অধীনস্থ পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি এই মেলার আয়োজক, তাই একে সরকারি নাট্যমেলাই বলা যেতে পারে। এই একাদশ নাট্যমেলার সাফল্য-অসাফল্য নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু বিস্ময় এবং আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করা গেছে কলকাতা ও শিলিগুড়িতে (নতুন সংযোজন) ৮+৫=১৩ দিনের এই মেলায় দর্শকের ঢল নেমেছিল। কলকাতার নামী প্রযোজনার ক্ষেত্রেই শুধু নয়, জেলা থেকে আসা তেমন নাম-না-জানা দলগুলির নাটক দেখতেও মানুষ লাইন দিয়েছেন, প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ করেছেন। অন্যান্য বছরের মতো এ বারও কোনও টিকিট রাখা হয়নি, বিনামূল্যে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করে দর্শকরা এসেছেন। কয়েকটি দল এবং কিছু সাংবাদিকও প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিনা টিকিটে কেন? দলগুলির আপত্তির কারণ বোঝা যায়: এক, আমাদের নাটকের ভাল বিক্রিবাটা হচ্ছে, বিশালসংখ্যক বিনিপয়সার দর্শকের একটা বড় অংশ তো নাটকটা টিকিট কেটে দেখতেনই, সে সব ‘খদ্দের’ আমরা হারাই কেন? দুই, বিনিপয়সার দর্শকদের সিরিয়াস দর্শক বলা যায় না, আর আমরা তো সিরিয়াস দর্শকের জন্যই থিয়েটার করে থাকি। এর উত্তরে কিছু কথা বলা যেতে পারে। |
|
প্রথমত, দর্শকরা বিনি পয়সায় দেখছেন সত্যি, দলগুলি কিন্তু বিনি পয়সায় অভিনয় করছেন না, সামান্য হলেও একটা দক্ষিণা তাঁদের দেওয়া হচ্ছে, হলভাড়া ও বিজ্ঞাপনের বিশাল ব্যয় বহন করতে হচ্ছে না, সব মিলিয়ে অঙ্কটা খুব একটা যাচ্ছেতাই নয়। জমে-যাওয়া নাটকের ক্ষেত্রে হয়তো ‘লাভ’ একটু কম হতে পারে, কিন্তু ‘ক্ষতি’ হচ্ছে নিশ্চয়ই বলা যাবে না। আর যাদের প্রযোজনা তেমন জমেনি কিংবা কলকাতার বাইরের দল, যাদের কাজের সঙ্গে স্থানীয় দর্শকদের তেমন পরিচিতি নেই, তারা তো বেশ লাভবানই হল। তা হলে কি জমা-নাটক এবং অ-জমা-নাটকের মধ্যে শ্রেণিভাগ করেই মেলার আয়োজন করা উচিত ছিল? দ্বিতীয়ত, ‘হাউসফুল’-করা দর্শকদের সবাই বুঝি খুব বোদ্ধা এবং সিরিয়াস? সস্তা নাটককে দিনের পর দিন ‘হাউসফুল’-করা বা ভুল জায়গায় হাসি-হাততালি-দেওয়া লঘু চরিত্র এবং অবোধ দর্শকদের সঙ্গে তো আমরা ভালই পরিচিত! মিডিয়াতেও তো দেখি গ্রুপ থিয়েটারের নাট্যচর্চার বিশাল ইতিহাসকে ভুলে গিয়ে অকিঞ্চিৎকর নাটক ও প্রযোজনা নিয়ে মাতামাতি! সত্যকারের কিছু অসাধারণ প্রযোজনা বা অভিনয় তো তাঁদের আলোচনার মধ্যে আসেই না।
ছোটবেলায় একটা কথা কোথায় যেন পড়েছিলাম: ‘অধনীর ধন হলে দিনে দ্যাখে তারা।’ গ্রুপ থিয়েটার যে চিরকালই অধনী, সেটা নতুন করে বলার কিছু নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে শিল্পগুণ ছাড়াও নানা কারণে একটা প্রযোজনা সেই কৃপা থেকে বঞ্চিত হয়। যে কারণেই হোক, প্রযোজনা জমে গেলেই আমি আমার চরিত্র খুইয়ে ফেলব, নীতি-আদর্শ ভুলে যাব, এ কেমন বাজার-মানসিকতা! শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত-অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা না-হয় বাদই দিলাম, গত শতকের ৭০-৮০-৯০-এর দশকের জনপ্রিয় প্রযোজনা ‘মারীচ সংবাদ’, ‘জগন্নাথ’, ‘নাথবতী অনাথবৎ’, ‘দায়বদ্ধ’, ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’-র অভিনয়সংখ্যা ৫০০ থেকে ৭০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, ‘সাজানো বাগান’ তো হাজার অতিক্রান্ত, তুলনায় এই সময়ের ‘হিট’ নাটক ‘উইঙ্কল্ টুইঙ্কল্’, ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ বা ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ ২০০ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি (তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে নির্দেশকদের কাছ থেকে), যদিও ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ স্টিল রানিং। তা হলে নাটকের দর্শকসংখ্যা বা তাঁদের আগ্রহ কমেছে না বেড়েছে?
আমার হিসেব এবং পর্যবেক্ষণ বলছে, কমেছে। এই সময়কালের মধ্যেই আমরা দেখেছি, আমজনতার সুস্থ বিনোদনক্ষেত্র সাধারণ রঙ্গালয় শুকিয়ে মরুভূমি, অসংখ্য অফিস-ক্লাব যারা রঙ্গমঞ্চগুলিকে বছরভর ব্যস্ত রাখত, তারা আর থিয়েটার করে না, করে না পাড়ার ক্লাবগুলি বা স্কুল-কলেজ, গণনাট্য সঙ্ঘ ক্ষীণতোয়া, এমনকী ওয়ান-ওয়ালও বন্ধ। সামগ্রিক ভাবে নাট্যজগৎ সংকুচিতই হয়েছে, একমাত্র আমরাই এখনও টিকে আছি বনরাজ্যে শেয়ালরাজা হয়ে। মূল ধারা বা রেখা লুপ্ত হয়ে গেলেও আমরা নাকি এখনও ‘অন্য’ বা ‘সমান্তরাল’। গ্রুপ থিয়েটার কমার্শিয়াল হোক, কর্পোরেট হোক, কোনও আপত্তি নেই। তা হলে তারা মুক্ত বাজারের শর্ত লঙ্ঘন করে কেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিশাল অংকের অনুদান নিচ্ছে, তার জন্য ‘লবিং’ও করছে, রাজ্য সরকারের কাছ থেকে হ্রাসমূল্যে হলভাড়ার বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে, কেনই বা রাজ্য সরকারের বিনোদন কর বা কর্পোরেশনের লাইসেন্স ফি থেকে রেহাই ভোগ করে, এমনকী সংবাদপত্রে হ্রাসমূল্যে বিজ্ঞাপনের সুযোগ নেয়?
রাষ্ট্র বা সরকার যেখানে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভর্তুকি দিচ্ছে, সেখানে তারা নাট্যদলগুলির কাছে এই আবেদন কি রাখতে পারে না যে, বছরে অন্তত একটি দিনের জন্য প্রেক্ষাগৃহগুলি সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হোক? সেটা কি খুব বেশি চাওয়া হবে? নানাবিধ সুযোগসুবিধা দিয়ে সরকার যেমন নাট্যের চর্চা ও প্রসারের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, আট-দশ দিনের মেলার মাধ্যমে সেই ভর্তুকি দিয়েই যদি তারা সাধারণ মানুষকে নাট্যমুখী করে তুলতে চায়, নাট্যদলগুলি কেন সহযোগিতা করবে না? আর একটা কথাও ভুলে গেলে চলবে না। যে-সব যুগান্তকারী প্রযোজনা বাংলা থিয়েটারের গর্বের কারণ ছিল, তাদের কপালে কিন্তু সেই যুগে কোনও সরকারি গ্রান্ট জোটেনি, বা অন্য সুযোগসুবিধাও।
|
রেপার্টরি এবং ‘রাজা লিয়ার’ |
‘রাজা লিয়ার’-এর নির্দেশক সুমন মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন। (‘সাংস্কৃতিক ভর্তুকি...’, ৭-১২) প্রযোজনাটি আমার নানা কারণে ভাল লেগেছিল। সুমন এবং সৌমিত্রদাকে বলেছিলাম যে, যথার্থ রঙ্গালয়ের প্রযোজনা গুণগত এবং মাত্রগত দিক থেকে কী হওয়া উচিত তার একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত এই প্রযোজনা। আমাদের পাবলিক থিয়েটার লুপ্ত হওয়ার কারণগুলি তো আমরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি না, খালি হা-হুতাশই করি। মঞ্চের সংস্কার বা আধুনিকীকরণ, দর্শক-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা, প্রযোজনায় উপযুক্ত পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন নাটক-নির্বাচন, অভিনয়, পরিচালনা, মঞ্চ-পরিকল্পনা, যান্ত্রিক বা প্রযুক্তিগত ইত্যাদি সৃষ্টিমূলক এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রকৃত সৃষ্টিশীল গুণী শিল্পী বা ডিজাইনার বা কলাকুশলীদের নিয়োগ করা তো হত না। ‘রাজা লিয়ার’-এর ক্ষেত্রে কৃতী নির্দেশক সুমনের চাহিদা মতো তা করা হয়েছে, তাই সাফল্যও পাওয়া গেছে। প্রথম দিকে খামতি ছিল মার্কেটিংয়ে, সেটাও এখন পুষিয়ে গেছে। এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে জাতীয় নাট্যশালা কিংবা পাবলিক কমার্শিয়াল থিয়েটার-এর, রেপার্টরি কিংবা গ্রুপ থিয়েটারের নয়। ‘রাজা লিয়ার’ একটি একক দৃষ্টান্ত হতে পারে পুঁজি বিনিয়োগকারী (যা বাংলা থিয়েটার কোনও কালেই পায়নি) সাধারণ রঙ্গালয়ের কাছে, অথবা সরকারের কাছে, যারা জাতীয় নাট্যশালার মর্ম বা উপযোগিতাই বোঝে না। আমাদের দেশে অর্থনীতি এবং নাট্যের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব গড়ে না-ওঠার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন সুমন। তাই বিদেশের বড় বড় তুলনা টানার মানে নেই। তা ছাড়া জাতীয় নাট্যশালা এবং রেপার্টরির স্কেলেরও বিস্তর ফারাক আছে। মিনার্ভা রেপার্টরি ‘উইথ আ ব্যাং’ শুরু করার হয়তো তাগিদ ছিল, কিন্তু এটা গ্রুপ থিয়েটার বা রেপার্টরির কাছে অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হতে পারে না। পাশাপাশি আবার অন্য দৃষ্টান্তও তো রয়েছে ‘দেবী সর্পমস্তা’। কম খরচে স্বল্প আয়োজনে সম্ভাবনাপূর্ণ প্রশিক্ষিত বেতনভুক অভিনেতাদের নিয়ে এই প্রযোজনা সাফল্য তো পেয়েই, দর্শক আকর্ষণও করেছে। এ বার শুধু মার্কেটিং বাকি। কলকাতায় বসে না-থেকে রাজ্যে এবং রাজ্যের বাইরে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করা। মিনার্ভার নতুন কমিটি এ সব নিয়ে ভাবুন। প্রসঙ্গত, সঞ্জনা কপূর পৃথ্বী থিয়েটারের সঙ্গে কুড়ি বছরের সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে ‘জুনুন’ নামে একটা নতুন কোম্পানি গড়েছেন। (‘দ্য টেলিগ্রাফ’, ১১-১২) তাকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখছেন তিনি!
সরাসরি ভর্তুকি নয়, কিন্তু সরকার বা কর্পোরেশন থেকে কিছুটা সাহায্য-সহায়তা সুযোগসুবিধা কিংবা ছাড় পাওয়া উচিত ছিল আমাদের অনুন্নত সাধারণ রঙ্গালয়গুলির। যেমন, এক সময় দেওয়া হয়েছে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে। তা হলে হয়তো দেনার দায়ে জর্জরিত হতে হত না তাদের। প্রমোটারদের কাছে বিক্রি করে দিতে হত না, পুড়িয়ে ফেলতে হত না সম্পত্তিগুলো। মনে পড়ছে, গত শতকের আশির দশকে কোনও এক সময় রাজ্য সরকার গ্রুপ থিয়েটারকে সাহায্য করার জন্য নিয়মিত সরকারি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের অভিনয়ের তালিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিশ্বরূপার স্বত্বাধিকারী রাসবিহারী সরকার রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ এনে মামলা করেন এবং জিতেও যান। মরণোন্মুখ সাধারণ রঙ্গালয় নিয়ে যে মানুষটি নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন, তাঁর তো রঙ্গালয়বিমুখ সরকারের ওপর ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। |
|
|
|
|
|