সম্পাদক সমীপেষু...
সেই বসতি আর এই বস্তি এক নয়
পরিবর্তনের এই পরিমণ্ডলে বদল হোক ‘বস্তি’ শব্দটার। একদিন আমরা কাজের মেয়েকে ‘ঝি’ বলতাম, ভৃত্যকে বলতাম ‘চাকর’। ‘চাকর’ বা ‘ঝি’ বলতে এক দিন কোনও আড়ষ্টতা বোধ করিনি। সাহিত্যে, গল্পে, উপন্যাসে, স্মৃতিকথায় ‘ঝি’, ‘চাকর’ শব্দ দুটো বারেবারেই এসেছে। সে দিন অস্বস্তি বোধ হয়নি, আজ হয়। আজ আর ‘চাকর’ বলি না, বলি ‘সহায়ক’। ‘ঝি’ বলি না, বলি ‘মাসি’। এমন অনেক শব্দই এখন আর ব্যবহার করি না আমরা। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও পরিবর্তন হয়।
সমাজের প্রত্যেক মানুষেরই অধিকার আছে পেট ভরে খাওয়ার ও ভাল ভাবে বাঁচার। হ্যাঁ, উপার্জনের তারতম্যে নিম্নবিত্তের মানুষ আরবান কমপ্লেক্সের বহুতল বাড়ির বাসিন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে না ঠিকই, তাকে মাটির কাছেই একতলা বাড়ির বাসিন্দা হয়ে থাকতে হয়। সেখান থেকেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলের পোশাক পরে পড়তে যাচ্ছে, যুবক-যুবতীরা কলেজে যাচ্ছে, পড়াশোনা করছে, পাশ করে চাকরিবাকরি করছে, সংসার করছে। কোনও লোকালয়ে গরিবও থাকে, ধনীও থাকে। কোনও স্বল্প উপার্জনের মানুষ ক্ষুদ্র কুটিরে মাথা গোঁজার মতো আশ্রয়ে বাস করে। কর্পোরেশন বা পুরসভা সেই সব মানুষের বাসকেন্দ্রকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করে রাখতে পারে, তাঁদের দুর্দশা দূর করে বাসস্থলের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য। কিন্তু আমরা তাঁদের ‘বস্তিবাসী’ বা ‘বস্তির ছেলে’ বা ‘বস্তির মেয়ে’ বলব না। ‘বস্তি’ শব্দের অর্থে সংসদ অভিধান বলছে, ‘পল্লি, দরিদ্র পল্লি, শহরে মাটির খাপরা টিন প্রভৃতি দিয়া ছাওয়া অপরিচ্ছন্ন ও ঘনসন্নিবিশিষ্ট গৃহশ্রেণি। (সং বসতি)।’ সংসদের ইংরেজি বাংলা ডিকশনারিতে Slum শব্দের অর্থে বলা হয়েছে, ‘অতি ঘিঞ্জি নোংরা পল্লি বা অঞ্চল।’ চলন্তিকা: ‘দরিদ্রের ঘনবিন্যস্ত কুটির শ্রেণি’। বঙ্গীয় শব্দকোষ: ‘১ বসতি, বাসস্থান, পল্লি, গ্রাম। ২ নিম্ন শ্রেণির জঘন্য অপরিষ্কৃত বাসস্থান।’
যদি পঞ্চাননতলার ছেলেরা নিজের প্রাণের মায়া না-করে রোগীদের বাঁচাবার জন্য আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তো সে জন্য তাঁরা অভিনন্দিত ও উচ্চ প্রশংসিত হবেন দেশবাসীর কাছে, এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য তাঁদের বারেবারে ‘পঞ্চাননতলার বস্তিবাসী’ বলে উল্লেখ করব কেন? তাঁরাও আমার-আপনার মতোই মানুষ। তাঁরাও লেখাপড়া করেন, চাকরি করেন, ছোট ছোট ব্যবসা করেন, কেউ বা শিক্ষকতা বা পৌরোহিত্যও করেন। তাঁদের কোনও কাজের গৌরবে স্বীকৃতি জানাতে গিয়ে আমরা তাঁদের বারবার ‘বস্তির ছেলেরা’ বলে উল্লেখ করব কেন? তাঁরা দরিদ্র, ছোট কুটিরে বাস করেন এটা ঠিকই, কিন্তু মানবিকতার দিক থেকে পঞ্চাননতলার ছেলেরা দেখিয়ে দিলেন, তাঁরাই তো সত্যিকারের বা প্রকৃত বড়লোক, বড় মানুষ। বিত্তশালী বড়লোকেরা অর্থের লোভে কত যে ছোট হতে পারেন, তা আমাদের অজানা নেই। তাই পঞ্চাননতলার ছেলেদের অসামান্যতার পরিচয় দিতে গিয়ে তাঁদের ‘বস্তিবাসী’ না-বলে বরং বলি, পঞ্চাননতলা অঞ্চলের বা পল্লির ছেলেরা। পঞ্চাননতলার এই ছেলেরা তো পঞ্চাননতলাতেই ছিল। তার পর তাঁদের মাথা থেকে সূর্যের আলো কেড়ে নিয়ে প্রমোটারদের রাজ্যপাট শুরু হল। গড়ে উঠল পাঁচ সাত দশতলা অট্টালিকা। খেলার মাঠ ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে তৈরি হল নার্সিং হোম, হসপিটালের বিরাট বিরাট বিল্ডিং। যাঁরা পুরাতন, টালি-ছাওয়া একতলার অন্ধকারে জীর্ণ কুটিরে পড়ে রইলেন, তাঁরাই শেষে বড় বাড়িগুলোর নীচে নিচুতলার বাসিন্দা হয়ে গেলেন। চিহ্নিত হলেন ‘বস্তিবাসী’ বলে। সংস্কৃত ‘বসতি’ থেকে ‘বস্তি’ এলেও এই ‘বস্তি’ আর সে দিনের ‘বসতি’ এক নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.