|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
২০১১: গণতন্ত্রের সন্ধানে চারটি মহাদেশ |
গণতন্ত্র নিজেই নিজের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে তোলে। আরব দুনিয়ার শিশু-গণতন্ত্রেও যেমন,
ভারত-ইউরোপ-আমেরিকার দুঁদে গণতন্ত্রেও তেমন। কে কোথায় কোন পথ নিচ্ছে সেটাই দেখার।
ঘটনাবহুল বিদায়ী বছরের অর্থ খুঁজেছেন
সেমন্তী ঘোষ |
মিশরের জেনারেল মোক্তার এল-মোল্লা কিছু কাল ধরেই সে দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একনায়ক হোসনি মুবারককে সরিয়ে দেওয়ার পর দেশের হাল ধরেছিল যে স্কাফ (সুপ্রিম কাউন্সিল অব আর্মড ফোর্সেস), মোল্লা তারই শীর্ষ নেতা। ক’দিন আগে একটা অসামান্য কথা বলেছেন তিনি। মিশরের নির্বাচন শেষ, সেই নির্বাচনে ইসলামি মৌলবাদীদের প্রতিপত্তি স্পষ্ট প্রকাশিত, এমন সময়ে মোল্লা প্রেস কনফারেন্স-এ বললেন, “মিশরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, আমরা কত বার কত শক্তির অধীন হয়েছি। ব্রিটিশ, ফরাসি, অটোমান। কিন্তু কেউ মিশরের মৌলিক চরিত্র পাল্টাতে পারেনি। আজও, পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যারাই আসুক না কেন, তারা মিশরের মৌলিক চরিত্র পাল্টাতে পারবে না।”
আশ্চর্য ভাবনা! এত দশকের অপেক্ষার পর এই প্রথম ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচন, সে যত সীমিত গণতন্ত্রই হোক না কেন: আর মোল্লা তুলনা টানছেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে? বলছেন, মিশরকে পাল্টানোর ক্ষমতা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের’ নেই? অথচ মোল্লার কথাটা কিন্তু অনেককেই খুশি করছে, আশ্বস্ত করছে, কেননা এত দিনের চেনা মিশর এ বার ইসলামি মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে ভোল পাল্টাবে কি না, সে দুশ্চিন্তায় তহরির স্কোয়্যারের বিদ্রোহীরা অনেকেই কাতর। এ বার কি তবে বোরখা? শরিয়তি আইন? ফতোয়া-রাজ? অনেকেই ভাবছেন, নিশ্চয়ই না, এখনও তো স্কাফ আছে। আর সেই সুযোগে মোল্লা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, মিশরের সংবিধান তৈরিতে শেষ কথা বলবে স্কাফ-ই। গণতন্ত্র এখনও মিশরে বড়ই শিশু কি না, এখনও পুরো ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সময় তার আসেনি। |
|
চ্যালেঞ্জ! তহরির স্কোয়্যার, কায়রো, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১, এ এফ পি। |
কথাগুলো মিথ্যে নয়। মিশরের ভবিষ্যৎ ভেবে আমরাও উদ্বিগ্ন। এও আমরা মানি যে, গণতন্ত্র নামক বহুতল ধোঁয়াবাড়ির এ নেহাতই একতলার ল্যান্ডিং। কিন্তু প্রশ্ন হল, তবে কি পার্লামেন্টকে উপেক্ষা করে সামরিক কর্তাদের সংবিধান রচনায় সম্মতি দেব আমরা? না কি বলব, যতটুকুই হোক না কেন, এই গণতন্ত্রকেও সম্মান জানাতে হবে, পার্লামেন্টকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দিতে হবে। বোধহয় দ্বিতীয় পথটাই নেওয়া উচিত। একটা নির্বাচন যখন হয়েছে, এবং প্রায় কেউই যখন সেই নির্বাচনের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আনেননি, সে ক্ষেত্রে ফলাফল যা-ই হোক না কেন, আমাদের মেনে নেওয়া উচিত। তা ছাড়া, মোল্লা এবং তাঁর গোষ্ঠীর চোখ দিয়ে দেখলে আদৌ কখনও সে দেশের গণতন্ত্র ‘বয়ঃপ্রাপ্ত’ হবে কি না, তাও কিন্তু আমরা জানি না। হয়তো ‘শৈশব’-এর যুক্তিতে তাঁরা, তাঁরাই মিশরের ক্ষমতায় বিরাজ করতে চান। ঠিক যেমন হয়েছে অন্যান্য বহু দেশে, পাকিস্তানে। মিশরের সামনে পথ এখন দুমুখো: গণতন্ত্র মানলে মৌলবাদ, না মানলে সামরিক কর্তৃত্ব!
গণতন্ত্রের পথটাই নেওয়া উচিত নিশ্চয়ই? এটা মনে রেখে যে, গণতন্ত্র জিনিসটা তেতো ওষুধ, নিস্তার নেই।
২০১১ সাল এই পুরনো কথাটা আর এক বার নিয়ে এসেছে আমাদের সামনে। মিশর ও অন্যত্র ‘গণতন্ত্র হাজির’ বলে যারা লাফালাফি করছি, তাদের ডেকে মনে করাচ্ছে, লাফালাফি করো, কিন্তু গণতন্ত্রের দামটাও মনে রাখো, ‘রিস্ক’টাও মনে রাখো। ‘গণতন্ত্র মূল্যবান’ বললেই পার পাবে না, মূল্যটা একেবারে কড়ায়-গণ্ডায় ধরে দিতে হবে। যেখানে যেমন, তেমনটাই ধরে দিতে হবে।
|
অমিত সম্ভাবনা |
যেখানে যেমন। আর সেই জন্যেই, কেবল মিশর কেন, ২০১১ সালে গোটা পৃথিবী জুড়েই এক দিকে গণতন্ত্রের অমিত সম্ভাবনা প্রস্ফুটিত হল, আর অন্য দিকে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ভাবে তার দাম চোকাতে শুরু করল, কিংবা তার দামের দরাদরি আরম্ভ করল। ‘আরব স্প্রিং’ বছরটাকে ঐতিহাসিক করে রাখল, একসঙ্গে এতগুলি দেশে এমন বিদ্রোহের ছড়াছড়ি কখনও দেখেছি কি আগে? কেউ বলছেন, দেখেছি সেই ১৮৪৮ সালের ইউরোপে, আর কোথাও নয়। ১৮৪৮: কার্ল মার্কস-এর সেই বিখ্যাত ‘এইটিন্থ ব্রুমেয়ার অব লুই নেপোলিয়ন’, ফরাসি সম্রাট লুই নেপোলিয়নের অষ্টাদশতম বছর, যখন ইউরোপের দিকে দিকে গণবিক্ষোভ গর্জে উঠছিল পুরোনো রাজত্বগুলির বিরুদ্ধে। তুলনাটা মন্দ নয়। তবে ১৮৪৮ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১১ কিন্তু দুর্দান্ত সফল।
এমন একটি ঐতিহাসিক বছরের নায়ক হিসেবে ‘বিদ্রোহী’কে বেছে না নিয়ে আমরা সেই বস্তাপচা ‘গণতন্ত্র’কে বেছে নিচ্ছি কেন? কেননা, এই বিদ্রোহীরা বাস্তবিক সর্বত্রই কুশীলবের চরিত্রে অভিনয় করছিল, বছর-’ভর আসল যাত্রাপালাটা লিখছিল অন্য এক জন: যার নাম গণতন্ত্র। টিউনিসিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, বাহরাইন, জর্ডন: সর্বত্র বিদ্রোহীদের এক দাবি, এক রোখ, গণতন্ত্র চাই। টিউনিসিয়ার মহম্মদ বুয়াজিজির আত্মহননের সূত্র ধরে একের পর এক দেশে বিদ্রোহীরা আগুন ধরিয়ে দিল, কথাটা নাটকীয়, বলতে-শুনতে ভাল, কিন্তু প্রশ্ন যখন, সব দেশ এক সঙ্গে আগুনের ফুলকিটার অপেক্ষায় কেন বসে ছিল, তখন কিন্তু সেই জায়গাটাতেই ফিরে যেতে হয়: গণতান্ত্রিক অধিকারের অভিলাষ। নিশ্চয়ই সমাজ-অর্থনীতির রসায়নে কোনও একটা স্তর পর্যন্ত এই আরব দেশগুলি এসে পৌঁছেছিল যেখানে গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন উঠতেই হত এ বার। কেমন সেই রসায়ন? জটিল প্রশ্ন। প্রতিটি ক্ষেত্রের নিজস্ব বিশিষ্টতাগুলিকে পাশে সরিয়ে রেখে এটুকুই বলতে পারি আমরা, বিশ্ব-অর্থনীতির দরজা যখন সমানেই খুলে যাচ্ছে, এবং তার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে যোগাযোগ-প্রযুক্তির বিপ্লব, সেই সময়ে এই দেশগুলির জনবিন্যাস-গত তথ্য দেখায় যে দ্রুত-বর্ধমান জনসংখ্যা, তুলনায় অনেক বেশি তরুণ ও কিশোরবয়সীদের উপস্থিতি, তুলনায় অনেক বেশি গ্রামীণ জীবনযাপনের হার, এই সব মিলিয়ে আরব অঞ্চলে বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি হয়েই ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার যেখানে সন্দেহাতীত ভাবে প্রথম লক্ষ্য ও গন্তব্য। ক্ষমতার সামান্য ফাটলের আভাসমাত্রেই ছিদ্রপথে বিপুল বন্যার মতো বেরিয়ে এসেছে সেই বিস্ফোরণ। আর বিস্ফোরণে যেমন হয়, যে সব দেশে গণতন্ত্রের সামনে প্রধান বাধা সরে গেছে, সেখানে এ বার গণতন্ত্র নিজেই হয়ে উঠছে নিজের প্রধান চ্যালেঞ্জ। মিশর, লিবিয়া বা টিউনিসিয়া, সর্বত্র গোষ্ঠী-সংঘর্ষ ও বিবাদ-বিতণ্ডার পরিচিত হযবরল-র মধ্যে বিভ্রান্ত মানুষ পা ফেলছে ২০১২-য়।
|
পালাবদল |
নিজেই নিজের চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ এখন পূর্ণশশীর মতো বিকশিত হয়ে উঠেছে বিশ্বের বহুকালের শক্তপোক্ত গণতন্ত্রগুলির চার দিকে। ইউরোপে চলছে পালাবদল। গণতন্ত্রের অস্ত্রে অপছন্দের শাসকদের ছুঁড়ে ফেলার খেলা। ইতালির বের্লুস্কোনি নিশ্চয়ই মনে রাখবেন ২০১১কে। মনে রাখবেন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনও, সর্বনাশ যে এতটাই শিয়রে তাঁর, সে কথা কি জানতেন তিনি বছর-শেষের নির্বাচন-নাট্যের আগে? ফ্রান্সে সারকোজিও শেষের সে দিনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। প্রস্তুত জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মার্কেলও। একের পর এক যে সব আর্থিক ও সামাজিক সংস্কার করে গিয়েছেন তাঁরা, এই বছরে গণতন্ত্রের নিষ্করুণ পদক্ষেপে তার দাম পোয়াতে হল। এটা একটা দিক। অন্য দিকটা আরও গুরুতর। আরব দেশগুলিতে যেমন বিদ্রোহ পথে নেমে এল গণতন্ত্রের দাবিতে, পশ্চিম দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রায় একই রকম বিদ্রোহ-দীর্ণ দিনযাপন করল, সে বিদ্রোহ অপশাসনের প্রতিবাদে, অতি-শোষণের প্রতিবাদে। রাশিয়া, ইতালি বা স্পেনে যে মানুষ এ ভাবে রাস্তায় আসতে পারে, দেখল অভিভূত ২০১১। আর গ্রিস? অর্থনৈতিক দুরবস্থার সীমা-পেরিয়ে যাওয়া দেশটি এক দিকে রাজকোষের চাপ, অন্য দিকে গণতন্ত্রের চাপে এ বার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধরে রাখবে কী ভাবে, এটা ২০১২-র অন্যতম বড় প্রশ্ন। তবে, বিস্ময়-কোঠায় সকলকে ছাপিয়ে যাবেই ব্রিটেন। এমন ভয়ানক নাগরিক দাঙ্গায় ছারখার হওয়ার উদাহরণ সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। প্রতিটি দেশের আলাদা পরিস্থিতি, আলাদা বিদ্রোহ। মৌলিক বার্তা কিন্তু একটাই। সমাজে উদার গণতন্ত্রের ধ্বজা ধরে অর্থনীতিতে সংকীর্ণ ধনতন্ত্রের পথ ধরে এগোনোর বিপদ বিরাট। কোনও একটা সমাধান লাগবে। গণতন্ত্রের সাম্য-অধিকারের বড়াই দিয়ে ধনতন্ত্রের অসাম্য-বঞ্চনাকে ‘ট্যাক্ল’ করা যাবে না। গণতন্ত্র ছেড়ে কথা কইবে না।
কথাটা ঠারেঠোরে বেরিয়ে আসে ইউরোপ থেকে, কিন্তু সোজাসাপটা বলে দেয় মার্কিন দেশের নজিরবিহীন বিদ্রোহ ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’। ‘১ শতাংশ’র যে স্লোগান বিদ্রোহীরা চালু করেছে, তার মধ্যেই এই জ্বলজ্বলে ঘোষণা। আর এই ঘোষণার মধ্যেই, সমাজ-অর্থনীতির দ্বন্দ্বের হাত ধরে গোটা ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে প্রবল ভাবে উঠে আসছে গণতন্ত্রের এক প্রচ্ছন্ন শক্তি: নাগরিক সমাজ।
কেবল ইউরোপ, আমেরিকা? জনংখ্যার দিক দিয়ে বৃহত্তম গণতন্ত্র তো এশিয়ায়, এবং নাগরিক সমাজের কথা বলতে হলে ২০১১ ফিরে তাকাবেই ভারতের দিকে। লোকপাল আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি-বুদ্ধি চলতে পারে, কিন্তু নাগরিক সমাজ কী ও কতখানি, সেই প্রশ্ন যে গভীরতায় তুলে এনেছে এই আন্দোলন, যে ভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রকে ফিরে ভাবতে বাধ্য করেছে, গণতান্ত্রিক শাসক-সমাজের অবধারিত দুর্নীতিপরায়ণতার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচের উপর জোর দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট, সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে এর প্রভাব। গণতন্ত্রের একটি ধাপ পেরিয়ে পরবর্তী ধাপে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছে ২০১১-র ভারত। এক দিক দিয়ে গৌরবময় মুহূর্ত। অন্য দিক দিয়ে সংকটময়ও। জননির্বাচিত প্রতিনিধিদের জন্য অ-নির্বাচিত ওয়াচ-ডগ? গণতন্ত্রকেই চ্যালেঞ্জ করা নয় কি?চ্যালেঞ্জ তো বটেই। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ কোনও কর্তৃত্ববাদ থেকে আসেনি, এটাই মজার। গণতন্ত্র নিজেই নিজের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আরব দুনিয়ার শিশু-গণতন্ত্রেও যেমন, ভারত বা ইউরোপ-আমেরিকার দুঁদে গণতন্ত্রেরও তেমন, নিজের ভেতর থেকে উৎসারিত সেই চ্যালেঞ্জ পেরোনো যাবে কী করে, আদৌ যাবে কি না, সেটা কিন্তু একান্তই পথ-নির্ভর। কে কোন পথ নিচ্ছে সেটাই এ বার দেখার। অন্তত চারটি মহাদেশ জুড়ে ২০১১ সাল তৈরি করে তুলল গণতন্ত্রের সেই চ্যালেঞ্জ পেরোনোর পথের সন্ধান ও সম্ভাবনা। |
|
|
|
|
|