তৃণমূলের বিরোধিতা থাকলেও আদায় করা গিয়েছিল বিজেপির সমর্থন। তবু কংগ্রেসেরই একটা বড় অংশের আপত্তির কারণে পেনশন বিল নিয়েও দ্বিধায় থাকতে হল মনমোহন সরকারকে। এখনও পর্যন্ত যা খবর, তাতে সম্ভবত সংসদের চলতি অধিবেশনে পেনশন বিল আনছে না সরকার। এই অবস্থায় সরকার ও দলের ঐক্য মজবুত করতে আজ আসরে নামতে হল কংগ্রেস সভানেত্রীকে।
আজ কংগ্রেস সংসদীয় দলের বৈঠকে সনিয়া গাঁধী বলেন, “অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে। তার আগে প্রতিনিয়ত বিরোধী দলগুলি গুজব ছড়ানোর চেষ্টা চালাবে যে সরকার ও কংগ্রেসের মধ্যে মতান্তর রয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট করে দিতে চাই, সরকার ও দলের মধ্যে কোনও মতান্তর নেই। বিভিন্ন বিষয়ে একাধিক মত থাকতে পারে। তবে কোনও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঐক্যবদ্ধ ভাবেই নেওয়া হয়।” অস্ত্রোপচারের পর এই প্রথম সংসদীয় দলের বৈঠকে আজ বক্তৃতা দেন সনিয়া। এবং ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করতে সংসদের সেন্ট্রাল হলে কংগ্রেস সাংসদদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেন।
শুধু পেনশন বিল থমকে যাওয়াই নয়, লোকপাল থেকে শুরু করে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির প্রশ্নে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস সভানেত্রীর আজকের মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এ সব ক’টি ক্ষেত্রেই দল ও সরকারের পৃথক সুর শোনা গিয়েছে। সরকার কোনও বিষয়ে প্রস্তাব করেছে তো বিক্ষিপ্ত ভাবে দলের নেতারা প্রকাশ্যে আপত্তি জানিয়েছেন। কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, “মতান্তর যদি না-ই থাকত, তা হলে হয়তো কংগ্রেস সভানেত্রীকেও এ ভাবে ঐক্যের দাওয়াই দিতে হত না। কিন্তু তিনিও বুঝতে পারছেন যে দল ও সরকারের সমন্বয়ের অভাব উভয়কেই দুর্বল করছে। তাই সংকটের মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।” একে তো লোকপাল নিয়ে ফের লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত। তার উপর উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন সামনে। সেই সময় দল ও সরকারের ‘মতবিরোধ’ বার বার প্রকট হয়ে ওঠার ঘটনা বিব্রত করছে সরকারকে। সংস্কার থমকে যাওয়ায় সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ আনছে শিল্পমহল।
শিল্পমহলকে ইতিবাচক বার্তা দিতেই পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিল আনতে চেয়েছিলেন মনমোহন। কারণ দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলি ভারতের ২০০ কোটি ডলারের পেনশন তহবিলের দরজা খুলে দেওয়ার জন্য সওয়াল করে আসছে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিজেপির সম্মতি পাওয়ার পরেও (ফলে বিল পাশ করা নিয়ে সমস্যা হত না) দল ও তাঁর সরকারের মধ্যেই মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় আপাতত থমকাতে হল মনমোহনকে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট অসন্তুষ্ট বলে তাঁর সচিবালয় সূত্রের খবর। প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসের মধ্যেই অনেক নেতার পেনশন বিল নিয়ে আপত্তি রয়েছে। তাঁদের মতে, পাঁচ রাজ্যে ভোটের আগে কেন্দ্র এই সিদ্ধান্ত নিলে কংগ্রেসের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, সনিয়া গাঁধীও মনে করছেন খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির মতো এ ক্ষেত্রে যেন প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে তা স্থগিত রাখতে না হয়। বরং সকলের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ করা ভাল।
সরকারি ভাবে অবশ্য বলা হচ্ছে, পেনশন বিল নিয়ে শরিক দল-সহ বিভিন্ন স্তরে মতপার্থক্য থাকায় সময় নিয়ে এগোনো প্রয়োজন। বিলে আপত্তির কারণগুলো জানিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন। প্রণববাবুও তাঁর আশঙ্কা দূর করতে তাঁকে কেন্দ্রের অবস্থান জানিয়েছেন লিখিত ভাবে। তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি বা পেট্রোলের দাম বৃদ্ধির মতো পেনশন বিল নিয়েও মমতা এখনই কোনও চরম অবস্থান নিচ্ছেন, এমনটা নয়। তিনি তাঁর আপত্তি কেন্দ্রকে জানিয়েছেন। সিপিএম যখন শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষা প্রশ্নে পেনশন বিলের পুরোপুরি বিরোধিতা করছে, তখন মমতার পক্ষেও সেই রাজনৈতিক পরিসর ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। যে কারণে তৃণমূলের তরফে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “তৃণমূলের আপত্তির জন্যই পেনশন বিল আনার বিষয়টি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
বিজেপি নেতৃত্বও মনে করছে, মমতার আপত্তিতেই কেন্দ্র পেনশন বিল পিছিয়ে দিচ্ছে। সরকারের তরফে তাঁদের তেমনই বার্তা দেওয়া হয়েছে। সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন কাল শেষ হচ্ছে। ২৭ ডিসেম্বর থেকে ফের তিন দিন অধিবেশন হবে। মাঝে বড়দিনের ছুটিকে কাজে লাগিয়ে সরকার ঐকমত্য তৈরি করতে পারে কি না, সেটাই দেখার। |