মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে জয়ললিতা বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা যখন খাদ্য সুরক্ষা বিল নিয়ে আপত্তি করছেন, তখন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, কেন্দ্রকে এই নীতি প্রণয়ন করতেই হবে।
সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, খাদ্য সুরক্ষা বিলটি আগামিকাল সংসদে পেশ করবে সরকার। তার আগে কংগ্রেস সংসদীয় দলের বৈঠকে সনিয়া আজ বলেন, “খাদ্য সুরক্ষার জন্য ২০০৯ সালে নির্বাচনী ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কংগ্রেস। এ ব্যাপারে এখনও কিছু উদ্বেগ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রস্তাবিত এই আইন আক্ষরিক অর্থেই মাইলফলক হয়ে থাকবে। দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূর করতে খাদ্য সুরক্ষা নীতি রূপায়ণ করতেই হবে কেন্দ্রকে।”
কংগ্রেসের আশা, প্রথম ইউপিএ জমানায় একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মতোই উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের আগে খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প ভোট রাজনীতির অঙ্ক তাদের অনুকূলে এনে দেবে। মূলত সেই উদ্দেশ্যেই কাল সংসদে বিলটি পেশ হওয়ার আগে আজ রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছেন সনিয়া। খাদ্য সুরক্ষা বিলকে যে কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রচারের মূল বিষয় করতে হবে, সে কথা আজ রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এ-ও ঠিক, সংসদে বিলটি পাশ করিয়ে মানুষের খাদ্যের অধিকারকে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া ও তার বাস্তবায়ন করতে এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে সরকারকে। কেননা শুধু শরিক তৃণমূল বা বিরোধী এডিএমকে-র আপত্তি নয়, সরকারের মধ্যেও ভিন্ন সুর রয়েছে।
যদিও খাদ্য প্রতিমন্ত্রী কে ভি টমাসের বক্তব্য, “কাল বিলটি পেশ করার পর সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হবে। ফলে আরও আলোচনা ও পরিমার্জনের সুযোগ রয়েছে।”
সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, শরিক ও বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলি থেকে খাদ্য সুরক্ষা বিল নিয়ে আপত্তি ওঠার আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। কারণ, আর্থিক বিষয় থেকে শুরু করে খাদ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য রাজ্যকে বহুমুখী দায়বদ্ধতা পালন করতে হবে। কিন্তু তার আগে সরকার ও কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই সুনির্দিষ্ট আপত্তির বিষয় রয়েছে। যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া বা কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ারদের বক্তব্য, বছরে ৪৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ মঞ্জুর করে একশো দিনের কাজ প্রকল্পটি শুরু করা সহজ হয়েছিল এই কারণেই যে, তখন অথনৈতিক বৃদ্ধির হার ছিল বেশি। আর এখন গোটা বিশ্বে মন্দা চলছে। শিল্পোৎপাদনের হার কমে গিয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এই অবস্থায় খাদ্য সুরক্ষা নীতি প্রণয়ন করতে গেলে অতিরিক্ত প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির বোঝা চাপবে সরকারের ওপর। সেটাই শেষ কথা নয়, গণবণ্টন ব্যবস্থার পরিকাঠামো উন্নয়ন ও হিমঘরের ব্যবস্থা করতে কমপক্ষে আরও সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকা লগ্নি করতে হবে সরকারকে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তা যে সহজ কাজ নয় তা মনমোহন সিংহ, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছেও স্পষ্ট।
আর্থিক বোঝা নিয়ে কেন্দ্রের নেতা-মন্ত্রীদের মতে উৎকণ্ঠা রয়েছে বহু রাজ্যেরও। মূলত সেই কারণেই তারা আপত্তি করছে। মুখ্যমন্ত্রীদের বক্তব্য, কেন্দ্র অতিরিক্ত ২৭,৯৭৩ কোটি টাকা ভর্তুুকি দেবে ঠিকই। কিন্তু গণবণ্টন ব্যবস্থার সংস্কার, খাদ্য কমিশন গঠন, রাজ্য জুড়ে আরও রেশন দোকান খোলার জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। রাজ্য সেই টাকা কোথা থেকে পাবে। পশ্চিমবঙ্গের প্রবল অর্থ সঙ্কটের পরিস্থিতিতে কাজটা যে কঠিন, তাতে সংশয় নেই। এ ছাড়াও প্রস্তাবিত বিলে বলা রয়েছে, আইন পাশ হলে বাধ্যতামূলক ভাবে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। কোনও ব্যক্তি তা না পেলে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে রাজ্য সরকার। একশো দিন প্রকল্পের মতো এ ক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণের দায় রাজ্যগুলি নিতে চাইছে না। বিশেষ করে গণবণ্টন ব্যবস্থার যা হাল, তাতে ক্ষতিপূরণের সামগ্রিক বহর খুব একটা কম হবে না বলেই তারা মনে করছে।
তবে কেন্দ্রের তরফে পাল্টা যুক্তিও দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, মিড ডে মিল, জননী সুরক্ষা যোজনার মতো বর্তমান প্রকল্পগুলি সামগ্রিক ভাবে খাদ্য সুরক্ষার ছাতার তলায় আনা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পগুলির জন্য কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক দায়ভার বণ্টনের অনুপাতের পরিবর্তন করা হচ্ছে না। খাদ্যে ভর্তুকির পুরোটাই কেন্দ্র বহন করবে। রাজ্যগুলির প্রধান সমস্যা, অর্থাভাবে তারা কোটার চাল-গম তোলে না। অতীতে এ জন্য বারবার পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারের সমালোচনাও করেছে কেন্দ্র। কিন্তু মানুষের অধিকারকে আইন করে স্বীকৃতি দিলে প্রথম কয়েক বছর অন্তত কোটার সব চাল-গম রাজ্যকে কিনতে হবে। রাজ্যগুলির প্রধান আশঙ্কা সেটাই। অন্য দিকে জয়ললিতার আপত্তির প্রসঙ্গে মন্ত্রিসভার এক নেতা বলেন, তামিলনাড়ু নিছকই রাজনৈতিক কারণে আপত্তি করছে। এই মুহূর্তে তামিলনাড়ু ২ টাকা কেজি দরে বিপিএল পরিবারদের চাল দেয়। যে চাল তারা কেন্দ্রের কাছ থেকে ৫ টাকা ৬৫ পয়সা দরে পায়। অর্থাৎ কেজি-পিছু ৩ টাকা ৬৫ পয়সা ভর্তুকি দেয় রাজ্য সরকার। কেন্দ্রের নয়া নীতি রূপায়ণ হলে বরং তারা তিন টাকা কেজি দরে চাল পাবে। তাতে ভর্তুকির বোঝা কমবে। ঠিক এই কারণেই ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা কোনও নেতিবাচক মন্তব্য করছেন না। কিন্তু জয়ললিতার আশঙ্কা, কেন্দ্র খাদ্য সুরক্ষা নীতি প্রণয়ন করলে কংগ্রেস তার রাজনৈতিক কৃতিত্ব নিতে চাইবে। |