একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়িতেই দমবন্ধকর পরিস্থিতি। রবার আর প্লাস্টিক পোড়া ধোঁয়ায় চার দিক অন্ধকার। দোতলা পেরিয়ে কোনও ক্রমে তিনতলায় পৌঁছলে পা আটকে যাচ্ছে কাদায়। সিঁড়ি দিয়ে ক্রমাগত নেমে আসছে জলের ধারা। কালো ধোঁয়ায় নিশ্বাস নেওয়া দায়। তিনতলার মেঝেতে ডাঁই হয়ে পড়ে শুধু ছাই হয়ে যাওয়া জিনিসপত্র। কোথাও কোথাও তখনও ধিকিধিকি আগুনের শিখা। আগুনের তাপে দেওয়াল থেকে খসে পড়েছে চাঙড়। ছাদ থেকে ক্রমাগত বৃষ্টির মতো জল পড়ছে। অগ্নিকাণ্ডের দু’দিন পরে, বুধবারেও এটাই তিলজলার কারখানার ছবি।
সোমবার রাত পৌনে ১১টা নাগাদ আগুন লাগে তিলজলার ২১এ/১ সি এন রায় রোডের এই জুতো কারখানায়। ঘটনাস্থলে যায় দমকলের ২২টি ইঞ্জিন। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। শেষ পর্যন্ত, ওই দিন বিকেলে আগুন আয়ত্তে এলেও সম্পূর্ণ নেভানো যায়নি। উল্টে বাড়ির গায়ে ফাটল ধরায় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। পুলিশ সূত্রের খবর, কারখানার লাগোয়া বাড়ির বাসিন্দাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীদেরও। |
পোড়া কারখানার বাইরের দেওয়ালে বিশাল বিশাল ফাটল। ভিতরের মেঝেতে ডাঁই হয়ে পড়ে পোড়া রবার আর প্লাস্টিক। বুধবার সকালেও বাড়ির তিনতলায়, পিছনের দিকে আগুন নেভাতে পাইপ দিয়ে জল ঢালছিলেন দমকলকর্মীরা। বাড়ির ভিতরে ঢুকতে নিষেধ করেছিলেন এক পুলিশকর্মী। কিন্তু দমকলের কর্মীদের সহযোগিতায় উপরে যাওয়ার অনুমতি মেলে। দমকলকর্মীরাই জানালেন, আগুনের তাপে উপরের মেঝে ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে। তাই জল ঢাললে ফাটল দিয়ে নীচে চলে আসছে। কিন্তু জল ঢালতেই হচ্ছে। কারণ, ইংরেজির ‘এল’ আকৃতির বাড়ির এককোনায় আগুন জ্বলছে এখনও। ধিকিধিকি আগুন পুড়ে যাওয়া ফোমের চাদরের তলাতেও। জিনিস সরানোর জন্য বেলচা মারতেই গলগল করে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া।
দমকল সূত্রের খবর, পোড়া জিনিসপত্র পুরোপুরি না সরালে আগুন নেভানো যাবে না। তাই এ দিন সকাল থেকে সেই কাজ শুরু হয়। তবে বিকেল পর্যন্ত পোড়া জিনিসের অর্ধেকও বার করা যায়নি। তিন-চারতলার মতো ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও জুতো কারখানার দোতলাতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আধপোড়া জুতো আর ফোম-রবারের চাদর। রয়েছে বস্তাবন্দি প্লাস্টিকের বল এবং ড্রামভর্তি রাসায়নিকের মতো দাহ্য পদার্থও। ভাঙা চেয়ার আর যন্ত্রপাতির মাঝে ইতিউতি পড়ে খাবারের খালি প্যাকেট, ছোট অগ্নি-নির্বাপক সিলিন্ডারও। দমকলকর্মীরা জানান, এত বড় কারখানায় ছোট কয়েকটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছাড়া আগুনের সঙ্গে লড়াইয়ের কোনও ব্যবস্থাই ছিল না।
শুধু আগুন নয়, দগ্ধ বাড়িটিও এখন চিন্তা বাড়িয়েছে পুলিশ-দমকলের। যে ভাবে ফাটল ধরেছে, তাতে যে কোনও সময়ে বড় বিপদ ঘটে যেতে পারে বলে আশঙ্কা। বাড়িটির বিভিন্ন অংশ প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। এ দিন সকালেও কয়েকটি কার্নিশ ভেঙে পড়ে। তিলজলার ওই ঘিঞ্জি এলাকায় জুতো কারখানাটির গা ঘেঁষে একাধিক বাড়ি। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি টালির বাড়ির বাসিন্দাদের অন্যত্র সরতে নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। এমনই এক বাসিন্দা জামিদা খাতুন বলেন, “আমাদের পরিবারে ১৫ জন সদস্য। ঘরে তালা দিয়ে সবাই পাশের এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছি।” এলাকাবাসীর অভিযোগ, কারখানা নিয়ে তাঁরা এর আগেও বহু অভিযোগ জানিয়েছেন। বছর চারেক আগে ওই কারখানার শব্দদূষণ নিয়ে মামলাও করেন তাঁরা।
বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের এক কর্মী জানান, বাড়িটির যা অবস্থা, তাতে ভেঙে ফেলা ছাড়া উপায় নেই। যে কোনও সময়ে তিনতলা আর চারতলা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে। ভাঙতে গেলে আশপাশের ছোটখাটো বাড়িগুলির ক্ষতি হতে পারে বলেও তিনি জানান। তবে কী ভাবে আগুন লাগল, তা এখনও স্পষ্ট নয় দমকলের কাছে। এ দিন দমকলের তরফে ওই কারখানার বিরুদ্ধে তিলজলা থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়।
সন্ধ্যায় পুরসভা ৪১১(৪) ধারায় কারখানার বিপজ্জনক অংশ ভাঙার নোটিস লাগিয়ে দেয়। ফরেন্সিক বিভাগ এখনও রিপোর্ট জমা না দেওয়ায় এ দিন অবশ্য বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করা যায়নি। কলকাতা পুরসভার ডিজি (বিল্ডিং) দেবাশিস কর এ দিন বলেন, “আশা করছি, বৃহস্পতিবার আমরা সরেজমিন ঘুরে দেখব বাড়িটি কী অবস্থায় রয়েছে। তার পরেই ভাঙার কাজ শুরু করা হবে।” বাড়িটির বিভিন্ন অংশে এখনও আগুন পুরোপুরি না নেভার কারণে এ দিন ভিতরে ঢুকতে পারেননি পুরসভার কর্মীরা। |