|
|
|
|
আজ শ্রীমা সারদার ১৫৯তম জন্মতিথি |
শ্রীশ্রীমা সারদামণি: বিবেকানন্দের ধ্রুবমন্দির |
তাপস বসু |
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৪-এ আমেরিকা থেকে সতীর্থ স্বামী শিবানন্দকে একটি চিঠিতে লিখছেন ‘মা ঠাকরুন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে।... রামকৃষ্ণ পরমহংস বরং যান, আমি ভীত নই। মা ঠাকুরানী গেলে সর্বনাশ।... দাদা, জ্যান্ত দুর্গার পূজা দেখাব, তবে আমার নাম। তুমি জমি কিনে জ্যান্ত জ্যান্ত দুর্গা মাকে যে দিন বসিয়ে দেবে, সেই দিন হাঁপ ছাড়ব।’
আসলে শ্রীমা সারদা বিবেকানন্দের ধ্রুবমন্দির শক্তি, প্রেরণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আশ্রয়-বিশ্বাসের উৎসস্থল। স্বামীজি এই সত্য বুঝেছিলেন গভীর ভাবে, নিঃসংশয়ে। তাই শিশুর সারল্যে, অগ্নিময় বিশ্বাসে, অপরিমেয় আস্থায় মাতৃসমীপে ছুটে গিয়েছেন বারংবার। তিনি নিজেকে মনে করতেন শ্রীমায়ের চরণাশ্রিত ‘দাস।’ ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শ্রীমার তিরোধানের পরে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, নেপথ্যে শ্রীমা সারদা না-থাকলে শ্রীরামকৃষ্ণ ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ হতেন না। শ্রীমা সারদা জীবন-সাধনায় শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনসঙ্গী রূপে ত্যাগে-তিতিক্ষায়, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে, উত্তরজীবনে কঠিন দারিদ্রে, বারেবারে ঠাঁই-নাড়া জীবনে অপরিসীম সহনশীলতায়, কঠিন তপশ্চর্যায় আবর্তিত হয়েছেন। তাই রম্যা রঁল্যা ‘ত্যাগে মহত্তমা’য় তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেন, আর সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন বলতে পারেন হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী তাঁর (শ্রীমায়ের) জীবন ও আদর্শ থেকে জেনে নিতে পারে শান্তির শিল্পকলা আত্মীকরণের কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ বাছবিচার করে দীক্ষা দিতেন, এমনকী খাদ্যাখাদ্যে ছোঁয়াস্পর্শও বিচার করতেন। শ্রীমা সারদা ছিলেন ঠিক এর বিপরীতে। হাজারো সমস্যায় ‘কিলবিল করা’ মানুষজনের দেখভালের পরিপূর্ণ দায়িত্ব যিনি কাঁধে তুলে নিয়েছেন, যিনি লোকজননী, তাঁর দুয়ার সকলের জন্য খোলা। যুক্তিবোধের আলোয় নরেন্দ্রনাথকে পাশ্চাত্যে পাড়ির অনুমতি দিয়েছেন, প্রত্যাবর্তনে সাদর গ্রহণ করেছেন। মার্গারেট নোবল, মিসেস ওলি বুল প্রমুখ সকলের সঙ্গে একাসনে বসে আহার করেছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে নারী জাগরণ ঘটবেই এটি স্বামীজির আকাঙ্ক্ষা শুধু নয়, কালের প্রেক্ষায় অবশ্যম্ভাবী।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনা শেক্সপিয়র ক্লাবে প্রদত্ত বক্তৃতায় স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পরে ঘরবাড়ি-পরিজন ছেড়ে আসা বারো জন তরুণের অসহায়তার কথা জানিয়ে তাঁদের একমাত্র ভরসাস্থল যে শ্রীমা, সে কথা মেলে ধরেছেন ‘সে কী হৃদয়যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণার তীব্রতা ছিল অসহনীয়।... সে দিন আমাকে সহানুভূতি দেখানোর কেউ ছিল না।... শুধু এক জন ছাড়া।... আমাদের গুরুদেবের সহধর্মিণী। কিন্তু তিনি
ছিলেন নিঃসহায়। আমাদের চেয়েও
তিনি ছিলেন দরিদ্র।’
শ্রীমা সারদা রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের সঙ্ঘজননী। সেই সূত্রেই তিনি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের শেষ কথা। তাঁর এই স্থানটি সর্বসমক্ষে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। ১৮৯৭-এর ১ মে অপরাহ্ণে বলরাম বসুর বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার দিন তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমাদের এই যে সঙ্ঘ হতে চলেছে, তিনি তার রক্ষাকর্ত্রী, পালনকারিণী, তিনি আমাদের সঙ্ঘজননী।’ তাই বেলুড় মঠের জন্য ক্রীত জমি কলকাতার প্লেগের ত্রাণের অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে স্বামীজি যখন বিক্রি করে দিতে চাইলেন, তখন বাধা দিলেন শ্রীমা। আরও বিস্তৃত পরিসরে প্রতিষ্ঠিত হল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় এবং আধুনিক পৃথিবীর নতুন তীর্থ। মিস হেনরিয়েটা মুলার প্রদত্ত ৩৯,০০০ টাকায় মঠের জন্য জমি কেনার পরে স্বামীজি অশক্ত শরীরের সারদা দেবীকে চেয়ারে বসিয়ে সমস্ত জমি প্রদক্ষিণ করিয়েছিলেন শক্তির স্পর্শে শুদ্ধিকরণের লক্ষ্যে। ১৯০১-এ যখন স্বামীজি বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো প্রবর্তন করেন, তখন মা’কেও দুর্গামূর্তির পাশে বসিয়ে শ্রীচরণে অঞ্জলি দেন। তাঁর ‘জ্যান্ত দুর্গা’ পুজোর অভীপ্সা সে দিন সার্থক হয়েছিল।
স্বামীজি প্রথম বার পাশ্চাত্য জয় করে ফেরার পরে সাষ্টাঙ্গে শ্রীমাকে প্রণাম করে জানান, সাফল্য শুধু মায়ের আশীর্বাদেই। অসুস্থ হয়ে পড়লে মা যখন তাঁকে দেখতে আসেন, তখন গঙ্গার পলিতে আটকে যাওয়া মায়ের নৌকাটি নিজে সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে ঠেলে দেন ফেরার সময়ে। মৃত্যুর আগে এক দিন শ্রীমাকে প্রণাম করে স্বামীজি বিনীত ভাবে নিবেদন করলেন তাঁর শেষ ও শাশ্বত উচ্চারণ, ‘মা, এইটুকু জানি, তোমার আশীর্বাদে আমার মতো তোমার অনেক নরেনের উদ্ভব হবে, শত শত বিবেকানন্দ উদ্ভূত হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে আরো জানি, তোমার মতো মা জগতে এই একটিই, আর দ্বিতীয় নেই।’
বিবেকানন্দের আত্মসংবিৎ, আত্মোপলব্ধি থেকে উৎসারিত এই বাণী তাঁর ‘ধ্রুবমন্দির’ শ্রীমা সারদার অবস্থানকে যুগ-যুগান্তে পরিব্যাপ্ত-সমৃদ্ধ করে চলেছে ‘সত্যিকারের মা’, ‘চিরায়ত জননী’ রূপে। |
|
|
|
|
|