|
|
|
|
যত বার হাত বদল তত বার বিষ মেশে চোলাইয়ে |
দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
মগরাহাটের মৃত্যুমিছিল ইথাইল ও মিথাইল অ্যালকোহলের পরিমাণের হেরফেরে। কিন্তু চোলাই-নেশার পদে পদেই বিছানো আরও অনেক মারণ উপাদান। যার মধ্যে সব চেয়ে ভয়ঙ্কর হল কীটনাশক।
ভাটি থেকে ডিলার। ডিলার থেকে ঠেক। যত বার হাত বদল, লাভ বাড়াতে তত বার চোলাইয়ে জল মেশানো হয়। ওই জোলো চোলাই খেয়েও যাতে নেশা হয়, তার জন্য প্রতি বারই মেশানো হয় কীটনাশক। কীটনাশকের মাত্রার হেরফেরে অনেক সময়ই মৃত্যু ডেকে আনে।
|
প্রায় পাঁচশো
চোলাই
ভাটি ও ঠেকের
মালিক খোঁড়া বাদশা। |
হালে এই কীটনাশক মেশানোর প্রবণতা বেড়েছে। ভাটি মালিকেরা জানাচ্ছেন, আগেও গ্রামে-গঞ্জে চোলাই ভাটির ছড়াছড়ি ছিল। কিন্তু সেখানে মদে এমন মিশেল দেওয়া হত না। যে হেতু খদ্দেরদের অধিকাংশই স্থানীয়, তাই ঠেকগুলিও সতর্ক থাকত। এখন বহু ঠেক-মালিক আর পাড়ার ভাটি থেকে চোলাই কেনেন না। অনেকেই অন্য জায়গা থেকে সস্তায় মদ নিয়ে আসেন। এবং খদ্দের টানতে ভাটি কিংবা ঠেকের মালিক কেউই চোলাইয়ে কীটনাশক মেশাতে দ্বিধা করেন না।
কী সেই কীটনাশক?
জনা কয়েক ভাটি-মালিক ও ঠেকের কারবারির সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, গ্রামের চাষিদের পরিচিত ঘন বেগুনি রঙের একটি কীটনাশক মেশানো হয় চোলাইয়ে। মগরাহাট-কাণ্ডের পরে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা জানতে পেরেছেন ওই কীটনাশকের নাম। বেগুন ও ঢ্যাঁড়সে বেশি পোকা হয় বলে সব্জির খেতে ওই কীটনাশকের ব্যবহার বেশি। উকুন মারার ওষুধ হিসেবে গ্রামের দোকানে যা বিক্রি হয়, তা-ও আদতে ওই কীটনাশক। এক চোলাই কারবারির কথায়, “চোলাইয়ের ড্রাম উনুন থেকে নামানোর পরেই ওই কীটনাশক মেশানো হয়। সেই মদ কিনে নিয়ে গিয়ে ঠেকের মালিকেরা কাপড়ের পুঁটলি করে চোলাইয়ের পাত্রে আর এক দফা কীটনাশক মেশায়।” |
বিস্তারিত... |
কীটনাশক মেশানোর দরকার পড়ে কেন?
ভাটি মালিকদের বক্তব্য, চড়া দরে কাঁচা মাল কিনে ও মজুরি দিয়ে এক জ্যারিকেন (২০ লিটার) চোলাই বানাতে যা খরচ হয়, তাতে লাভ খুব কম। তার উপরে পুলিশ ও আবগারি বাবুদের একাংশকে প্রতি মাসে কম করেও চার হাজার টাকা দিতে হয় বলে অভিযোগ। রাজনৈতিক দল ও ক্লাবগুলোর নানা অনুষ্ঠানে মোটা চাঁদাও দিতে হয়। তাই লাভ বাড়াতে চোলাইয়ে জল মেশাতেই হয় বলে দাবি ভাটি মালিকদের। দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোচারণ এলাকার এক ভাটি মালিক বলেন, “২০ লিটার চোলাইয়ে ১০ লিটার পর্যন্ত জল মেশানো হয়। এতে ২০০ টাকার মতো লাভ পাওয়া যায়।”
আর এখানেই বিপদ ওৎ পেতে থাকে। চোলাইয়ে জল মেশালে ঝাঁঝ ও নেশা দুই-ই কমে। সেই ঘাটতি পূরণ করতে কীটনাশক ব্যবহার করেন চোলাই কারবারিরা। হাওড়ার চেঙ্গাইলের এক ঠেক মালিক বলেন, “ভাটির চোলাই সরাসরি বিক্রি করলে তেমন লাভ থাকে না। তাই আমাদেরও জল ঢালতে হয়। নেশা বাড়াতে কীটনাশকও মেশাতে হয়।” এর ফলে খদ্দেরের হাতে পৌঁছনোর আগে বিভিন্ন হাত ঘুরে চোলাইয়ে ঠিক কতটা কীটনাশক মিশল, তার কোনও হিসেব থাকে না কারও কাছেই। ফলে নেশার খোঁজে আসা মানুষের যে কোনও সময় প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা।
হঠাৎ করে যদি মৃত্যু না-ও আসে তা হলেও ক্ষয়ক্ষতির চোরা স্রোত বইতে থাকে নেশাগ্রস্তের শরীরে। চেঙ্গাইলে মদ বিক্রেতা এক মহিলা বলেন, “এক-দেড় বছর হল দেখছি, চোলাই খেলেই ঘরের লোকটা কেমন পাগল পাগল করছে। আগে বুঁদ হয়ে থাকত, এখন কাউকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না।”
নিঃশব্দে মারণ-জাল ছড়াচ্ছে! |
|
|
|
|
|