|
|
|
|
|
ছাত্রীর সম্প্রদানে ডাক
পড়ল কলেজ শিক্ষকের |
|
কথায় কথায় সংঘর্ষ। পুলিশকে ডাক। ঘেরাও বা ধর্মঘট। কিন্তু কলেজ বলতে এই
ছবিটাই
চিরকালীন নয়। গুরু-শিষ্য সম্পর্কের উজ্জ্বল ইতিহাসের কথা শোনাচ্ছেন
অনল আবেদিন |
দ্বারকা নদীর পাশে খড়গ্রামের ইন্দ্রাণী গ্রাম। বর্ষায় দ্বারকা সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। নদীর পাড় লাগোয়া এলাকা বন্যার জলের হারিয়ে যায়। কিন্তু ফের জল সরতেই শুকিয়ে কাঠ নদী ও লাগোয়া গ্রামগুলি। এই ভাবেই বন্যা ও খরা ওই তল্লাটের ফি বছরের ভবিতব্য। এ হেন দারিদ্রপীড়িত তপসিলি জাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত অজ পাড়াগাঁয়ের স্কুলে ছেলেমেয়েরা নিজেদের ক্যামেরায়, নিজেদের পরিচালনায় ও নিজেদের অভিনয়ে স্বল্প দৈর্ঘের সিনেমা তৈরি করার পরে দেশি-বিদেশি ৬টি সিনেমা নিয়ে ৪ দিনের চলচিত্র উৎসব সুচারু ভাবে সম্পন্ন করেছে।
অবিশ্বাস্য?
তা হলে শুনুন, নেপথ্যে সেই ছাত্রদরদী শিক্ষকেরাই। তাঁরা হলেন সৈয়দ তৌফিক উল ইসলামের নেতৃত্বে ‘ইন্দ্রাণী হাসনা মায়ানি হাইস্কুল’-এর এক ঝাঁক শিক্ষকশিক্ষিকা। তৌফিকদের সেই শুরুর আগে সলতে পাকানোর পর্বটি অবশ্য রয়ে গিয়েছে কলেজে জীবনে।
কলেজ জীবনের কথা উঠতেই তৌফিকের আক্ষেপ, “স্যারের বাড়িতে অনেক দিন যাওয়া হয়নি, গাছ থেকে পাকা কাঁঠাল পেড়ে খাওয়াও হয়নি অনেক দিন!” স্যার অর্থাৎ কৃষ্ণনাথ কলেজের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শক্তিনাথ ঝা।ঁ তাঁর বাড়ির কাঁঠালের পাকা কোয়ার স্বাদ সহযোগে কাব্যের ছন্দ ও অলঙ্কারের পাঠ নেয়নি কৃষ্ণনাথ কলেজের বাংলা বিভাগের এমন পড়ুয়ার হদিশ পেতে রীতিমতো গবেষণার প্রয়োজন। কলেজের মাঠে অথবা শক্তিবাবুর বাড়িতে তাঁর পেতে দেওয়া শীতলপাটিতে বসে তাঁর কাছ থেকে ‘নোটস’ নেয়নি, কৃষ্ণনাথ কলেজের বাংলা বিভাগের এমন পড়ুয়া সত্যিই অমিল।
তৌফিক বলেন, “আমার সহপাঠী জয়নাল তখন বেকার। বহরমপুরে আত্মীয়ের বাড়ির আশ্রয়টুকও সে তখন খুইয়েছে। এগিয়ে এলেন স্যার। শক্তিবাবুর বাড়িতে আশ্রয় মিলল তার। এখন স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় সেই স্যারই আমাদের চলার পথের আলোক বর্তিকা।” সেই আলোর রোশনাইকেই পথ খুঁজে নিয়ে ৭-৮টি গ্রামের মধ্যবয়স্ক একটি প্রজন্মকে সাক্ষর করেছেন তৌফিকেরা।
তৌফিক বলেন, “আমাদের স্কুলে অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। তাদের বাবা-মাকে সাক্ষর করাটা ছিল আগে জরুরি। সেই ভাবনা থেকে ছাত্রছাত্রীদের বলা হল, তারা তাদের বাবা-মাকে সাক্ষর করতে পারলে তাদের কর্মশিক্ষার বিষয়ে নম্বর মিলবে। নচেত নয়।” কয়েক মাস পরে বাবা-মায়েরা স্কুলে গিয়ে সাক্ষরতার পরীক্ষা দিয়ে সন্তানদের রেজাল্ট সিটে নম্বর তুললেন। এমন গুরুকুলের প্রশিক্ষিত ২৭ জন স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়ে এ বছর জানুয়ারিতে স্কুলছুট এক জনকে কী ভাবে স্কুলে ফিরিয়েছে, তা নিয়েই স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা তৈরি করে। তার পর প্রত্যন্ত এলাকার ওই স্কুলের প্রাঙ্গনে ৪ দিন ধরে চলে চলচিত্র উৎসব। ‘দ্যা লায়ন কিং’, ‘বেবিজ ডে আউট’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘তারে জমিন পর’ ও ‘সোনার কেল্লা’র মতো সিনেমা দেখানো হয় ওই উৎসবে।
গুরু-শিষ্যের সর্ম্পকের আর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ কৃষ্ণনাথ কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান কেদারেশ্বর চক্রবর্তী ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। বছর দশেক আগের কথা। প্রাক্তন ছাত্রী গার্গী চক্রবর্তীর বিয়ের অনুষ্ঠান। তাঁর বাবা বহরমপুর কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মৃণাল চক্রবর্তীও স্বাভাবিক কারণেই সেখানে হাজির। তবুও কন্যা সম্প্রদান করতে ডাক পড়ে স্বয়ং কেদারেশ্বরবাবুর। কেদারেশ্বরবাবুর ছাত্র বর্তমানে কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের শিক্ষক অখিল সরকার বলেন, “গার্গী একা নন, সোমা গুপ্ত, রাখি বাজপেয়ি ও বুলবুল মণ্ডলের মতো অনেক প্রাক্তন ছাত্রীর বিয়েতে কন্যা সম্প্রদান করতে হয়েছে স্যারকে। নবগ্রামের বুলবুল মণ্ডলেকে তো স্যার নিজের বাড়িতে রেখে লেখাপড়াও করিয়েছেন।” এমন ‘স্যার’-এরই প্রাক্তন ছাত্রদের তালিকায় রয়েছেন রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য করুণাসিন্ধু দাসও। |
(শেষ) |
|
|
|
|
|