পাখিদের এই পাঠশালাতে
ভোরে মাঝেমধ্যে কৃষ্ণচূড়া গাছে এসে বসে বাঁশপাতি। বাগানে দেখা মেলে দামা-র। নিমগাছে বসে ইতিউতি তাকিয়ে গলা কাঁপিয়ে উড়ে যায় বসন্তবৌরি। খুব দূরে নয়, এই পাখিদের দেখা মিলবে যাদবপুরের গাঙ্গুলিবাগানে।
যাদবপুরের গাঙ্গুলিবাগান অঞ্চলটি গাছগাছালি ভরা। রয়েছে পুকুরও। ফলে পাখিদের অবারণ আনাগোনা। তবে সব সময়ে সবার দেখা মেলে না। মার্চে হাজির হয় দামা। শালিকের চেয়ে একটু বড়। উজ্জ্বল মরচে-রঙা মাথা-ঘাড়-গলা-বুক, ডানা-লেজ নীলচে ছাই। বেশির ভাগ সময়ে জমি খুঁটে খুঁটে পোকা খাওয়ায় ব্যস্ত। পেট ভরলেই মন ভরে আর কী! তবে বিপদের গন্ধ ঠিক সময়ে পেয়ে যায়। বিড়াল দেখলেই ভোঁ। মিষ্টি গলা হলেও খুব একটা ডাক শোনা যায় না।
নীলকণ্ঠ বসন্তবৌরি
আসে দুধরাজও। মেয়ে দুধরাজেরই দেখা মেলে বেশি। বুলবুলের চেয়ে একটু বড়। চকচকে নীলচে কালো মাথা-ঘাড়-ঝুঁটি। তলপেট সাদা, বুকের উপর দিক গাঢ় ধূসর। ডানা, লেজ উজ্জ্বল মরচে। প্রায়ই দেখা যায় বসন্তবৌরিকে। নিমগাছই তার প্রিয়। বেশি ক্ষণ বসে থাকতেও চায় না। নির্জন সকালে বা দুপুরে লাল চাঁদিওয়ালা সবুজ বসন্তবৌরির ধাতব স্বরে চমক লাগে। এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে, আকাশ-নীল গলা কাঁপিয়ে উড়ে যায়। সে সময়ে তার রঙের বাহার দেখার মতো।
পুকুর আছে। আছে মাছও। ফলে মাছরাঙাও আসে। তাদের নানা প্রজাতি। তবে এখানে সাদা বুক মাছরাঙা, ছোট নীল মাছরাঙা আর গুড়িয়াল এই তিন ধরনের দেখা মেলে। পাশেই, লম্বা-সরু পা ফেলে হেঁটে বেড়ায় ডাহুক। সংখ্যায় তারা দুই। পোকা খুঁটে খায়। গলার জোরে তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন।
কাছের কৃষ্ণচূড়া গাছ বাঁশপাতির বিশেষ প্রিয়। কয়েক দিন আগে পর্যন্ত এ গাছেই সে প্রাতর্ভ্রমণ করতে আসত। পোকা দিয়ে প্রাতরাশ সারত। এ খাবার যে তার পছন্দ নয় তা দেখলেই বোঝা যায়। যেন ট্যাবলেট গিলছে! কিছু দিন আগে কৃষ্ণচূড়া গাছে বাসা বানানো শুরু করেছিল এক জোড়া ফিঙে। কী জানি কেন মাঝপথে ছেড়ে দিল। শেষ রাতে ফিঙের ঘুম ভাঙানিয়া আলাপ এ অঞ্চলে অনেকেই শুনেছে। সঙ্গে গলা মেলায় দোয়েলও।
বসন্তবৌরি সাদাবুক মাছরাঙা
তবে খঞ্জনের আসা কমে গিয়েছে। আগে তিন ধরনের খঞ্জন প্রায়ই আসত। এ বছরের মার্চে একটি জংলি খঞ্জন এসেছিল। অক্টোবরে এল দু’জন। নারকেলের ডালই যেন এক জোড়া হরিয়ালের বিশেষ পছন্দ। তান শোনাতে প্রায়ই আসে বেনেবউ। আর লাফালাফিতে ওস্তাদ ফটিকজল। স্ত্রী ফটিকজলের এই চঞ্চলতা দেখতে এ বছর হাজির হয়েছিল এক পুরুষ ফটিকজলও।
উচ্চতায় বোধহয় আপত্তি আছে কুবো-র। গাছের নিচু ডালেই তার বিচরণ। বড় বড় শামুক ধরে ছাদের আলসেতে বসে ভেঙে খায়। গাছের থেকে ছাদে কাপড় শুকোতে দেওয়ার জন্য খাটানো বাঁশেই বেশি সময় কাটায় সোনালি-পিঠ কাঠঠোকরা আর হলদেটে-বুক কাঠঠোকরা। কিন্তু ভীমরাজ চিন্তায় রেখেছে। বছর কয়েক আগেও ইলেকট্রিকের তারে দু’-এক জন দোল খেত। এখন দেখা যায় না। এর ঠিক বিপরীতে হাঁড়িচাচা। প্রতি বছরই সংখ্যায় বাড়ছে।
বেনেবউ বাঁশপাতি
কোঁচ-বক আর গো-বক স্বভাবে শান্ত। পুকুরপারে আপন মনে পায়চারি করে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে খাবার খোঁজে। গো-বকের মাথা-ঘাড়-গলার হলদেটে-কমলা রং দেখলে বুঝবেন বিরক্ত করা উচিত নয়। এ তাদের অভিসারের সময়। পুরুষ দুর্গা টুনটুনি আবার অভিসারের সময়ে মাথা-ঘাড়-গলায় ধাতব নীলে সাজিয়ে তোলে। জবা আর করবী ফুলের মধু তাদের বিশেষ পছন্দ। পুরুষ মৌটুসির সারা গায়ে নীলচে লাল, লাল, বেগুনির ছড়াছড়ি। তবে মেয়ে মৌটুসিরা যেন সাজতে রাজি নয়। তাই তাদের বাহার কম।এখানে শালিকদের ঝগড়া করতে কেউ বারণ করেন না। তাদেরও নানা জাতি। এখানে আসে ঝুঁট শালিক, গো-শালিক আর সাধারণ শালিক। ঝগড়ায় শালিকের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে ছাতারেরা। অন্য সময় পোকা খুঁটে খেয়ে আর শুকনো পাতা উল্টে-পাল্টে তারা সময় কাটায়। ছিটে ঘুঘুও আসে বেশ কিছু।
দামা দুর্গা টুনটুনি
টুনটুনি আর বুলবুলিদের গলাবাজিতে বাগান ভরে। শীত কাটলেই কুহু কুহু করে সকাল-বিকেল নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় কোকিল। পানকৌড়িও থাকে আপন মনে। খিদে চড়লে পুকুরে ডুব মেরে মাছ ধরে নারকেলের ডালে ভোজ সারে। ভোরে আর সন্ধ্যায় দর্শন মেলে ঝাঁক বাতাসির। একটি টিয়া এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে।
মাঝেমধ্যে একটি কাজলপাখিও সবার খোঁজ নিয়ে যায়!




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.