|
|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
এই শীতে মল্লভূমে
মন্দির এখানে সাধারণ কুটীরের মতো।
তীর্থ এখানে পথের প্রান্তে নয়, পথের দু’ধারে।
বিষ্ণুপুর
ঘুরে লিখছেন আশিস পাঠক |
|
হাতের কাছে হয় না খবর, কী দেখতে যাও দিল্লি-লাহোর।
মনে পড়ে গেল লালনের গানটা। সবে তখন ট্রেনে চেপে বসেছি। গন্তব্য বিষ্ণুপুর। এ বাংলায় বহু বিষ্ণুপুর আছে। কিন্তু আমরা যাব সেই মন্দির-নগরী, দশাবতার তাসের জন্মভূমি, বালুচরীর বিষ্ণুপুরে। ইতিহাসপ্রেমীরা যোগ করবেন আরও দু’টি, সাত বাঁধের, লালবাঈয়ের বিষ্ণুপুর।
ইতিহাস, ঐতিহ্যের স্থাপত্য, লুপ্তপ্রায় লোকশিল্প আর নিছক রিকশা করে ঘুরে বেড়ানোর মজা কলকাতা থেকে হাতের কাছে, অর্থাৎ মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার দূরত্বে এত কিছু! তাই মনে পড়ে গিয়েছিল লালনের গানটা।
ট্রেনের সময় অনুযায়ী, দিনের বিভিন্ন সময়ে নামা যায় বিষ্ণুপুর স্টেশনে। কিন্তু প্রথম দেখা হলে, বিকেলে নামাই ভাল। স্টেশন থেকে গাড়ি, অটো বা রিকশা যে কোনও কিছুতে যাওয়া যায় বিষ্ণুপুর শহরে। তবে রিকশ নেওয়াটাই ভাল। শহরটা রয়েসয়ে দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। সময় লাগবে আধ ঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিট। দুপুর-গড়ানো বিকেলের রাঙা আলোয় প্রথম নজরে পড়বে রাসমঞ্চ। |
|
|
জোড়বালো মন্দির |
শ্যামরায় মন্দির |
|
পিরামিডের মতো গঠন এই রাসমঞ্চের। পিরামিডের পাদদেশে সারবন্দি বাংলা দোচালা ও চারচালা ঘর অলঙ্কারের মতো। বীর হাম্বীর আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করান এই রাসমঞ্চ। রাসের সময় বিষ্ণুপুরের সব মন্দিরের সব বিগ্রহ সাধারণের দেখার জন্য নিয়ে আসা হত এখানে। এই রাসমঞ্চে ঢোকার মুখে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কাউন্টার থেকে টিকিট কিনতে হয় বাকি মন্দিরগুলির কয়েকটি দেখার জন্য। তবে বেশ কয়েকটি মন্দিরে ঢুকতে কোনও টিকিট লাগে না। মন্দির
দেখার সবচেয়ে ভাল যান রিকশা। কারণ, কয়েকটি মন্দির সরু গলি দিয়ে যেতে হয়, গাড়ি নিয়ে গেলে অসুবিধে হতে পারে।
বিষ্ণুপুরে বহু মন্দির আছে। তার মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য মদনমোহন মন্দির (১৬৯৪-তে মল্লরাজ দুর্জন সিংহ নির্মাণ করান), লালজি মন্দির (দ্বিতীয় বীরসিংহ, ১৬৫৮), রাধাশ্যাম মন্দির (চৈতন্য সিংহ, ১৭৫৮), শ্যামরায় মন্দির (রঘুনাথ সিংহ, ১৬৪৩) এবং জোড়বাংলা বা কেষ্টরায়ের মন্দির। |
|
|
গুমগড় |
পাথরের রথ |
|
এই জোড়বাংলাই সম্ভবত বিষ্ণুপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দির। পরস্পর সংযুক্ত দু’টি দোচালা কুটীর নিয়ে তৈরি এই আশ্চর্য মন্দিরটি আনুমানিক ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি নির্মাণ করান মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ। আর আছে মূল দুর্গে প্রবেশের দু’টি পাথরদরজা, ছোট ও বড়। মন্দির দেখার পথেই দেখে নেওয়া যায় পাথরের রথটি, যে রথের গঠনে যেন গোটা বিষ্ণুপুরের মন্দিরশৈলীর মিনিয়েচার সংস্করণ। আর আছে আচার্য যোগেশচন্দ্র সংগ্রহালয়, যেখানে পুরাকীর্তির পাশাপাশি আছে বিষ্ণুপুরের লোকশিল্প ও সঙ্গীতের বিষ্ণুপুর ঘরানা সম্পর্কে
উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ। |
|
ছোট পাথর-দরজা |
মন্দিরগুলির প্রায় সবক’টিতে পোড়ামাটির ফলকে নানা ছবি। কখনও রাসমণ্ডল, কখনও বা রামায়ণ-মহাভারতের নানা কাহিনি। এমনকী, ফলকের পরে ফলকে অনুসরণ করা হয়েছে গোটা একটি কাহিনিবৃত্ত। কিন্তু মহাকাব্য বা পুরাণের কাহিনিই শুধু নয়, পোড়ামাটির ফলকে ঠাঁই পেয়েছে নিছক দৈনন্দিনের নানা মুহূর্তও। একচালা, দোচালা, চারচালার গড়নে তৈরি মন্দিরের গায়ে প্রতি দিনের জীবনের ছবিগুলি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল দেবতাকে প্রিয় করা আর প্রিয়কে দেবতা এ বোধহয় বাঙালির মতো করে আর কেউ পারেনি। মন্দির এখানে সাধারণ কুটীরের মতো। তীর্থ এখানে পথের প্রান্তে নয়, পথের দু’ধারে। |
|
আর ঠিক তেমন করেই পথের পাশের কোনও সাধারণ মানুষের বাড়ির মতোই বিষ্ণুপুরের রাজবাড়ি। দোতলা নয়, একতলা। এখন তা প্রায় ভগ্নাবশেষে পরিণত হয়েছে। কয়েক জন প্রবীণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা রাজপ্রাসাদে বাস করতে চাননি, দেবালয় ছাড়া আর কোনও বাড়ি সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়াক, চাননি তাও। আর এই বিশ্বাসেরই আর একটা পিঠ যেন দলমর্দন বা দলমাদল কামান দাগার লোকশ্রুতি। ভাস্কর পণ্ডিতের মরাঠা বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজা গোপাল সিংহের আমলে নাকি এই কামান দেগেছিলেন স্বয়ং মদনমোহন, বিষ্ণুপুরে লোকশ্রুতি এমনই। |
|
লালবাঁধ, মন্দিরবৃত্ত দেখার শেষে রাসমঞ্চের কাছেই, দলমাদল কামানটির সামনে দাঁড়িয়ে, যুক্তিবাদী মন বিশ্বাস করল না কথাটা। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। রাসমঞ্চের সামনের মাঠে আসর বসেছে বৈষ্ণব গানের। নিতান্ত এ কালের সেই গান যেন সব যুক্তির বাধা ডিঙিয়ে নিয়ে গেল বহু যুগের ও পারে, জীবন্ত হয়ে উঠল ভাঙা মন্দির আর গভীর ভক্তির বিষ্ণুপুর। |
দশাবতার তাস |
মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, রাম (রঘুনাথ), ভৃগুরাম (পরশুরাম), বলরাম, জগন্নাথ (বুদ্ধ) ও কল্কী এই দশ অবতারকে নিয়েই দশাবতার তাসের পরিকল্পনা। দশটি তাসের প্রত্যেকটিতে এদের মূর্তি আঁকা থাকে। প্রত্যেক অবতারের অধীনে একটি করে ‘উজির’-এর ছবি আঁকা তাস। প্রত্যেক ‘উজির’-এর অধীনে দশটি করে তাস, অবতারদের প্রতীকী অস্ত্র আঁকা। মোট ১২০টি। খেলায় পাঁচ জন খেলোয়াড় লাগে। মল্লরাজাদের সময়েই বিষ্ণুপুরে এ খেলা জনপ্রিয় হয়। তাস আঁকার পদ্ধতিটিও বিচিত্র। কাপড় তিনভাঁজ করে পরপর সাজিয়ে তেঁতুলবীচির আঠা বা ‘মাড়ি’ দিয়ে সাঁটা হয়। তার পরে খড়িমাটির প্রলেপ একাধিক বার দিয়ে শুকিয়ে নেওয়া হয়। তার পরে ঝামাপাথর দিয়ে ঘষে যথাসম্ভব মসৃণ করা হয়। তার পরে চক্রাকারে কেটে তাস চিত্রণ শুরু হয়। |
|
|
বালুচরী |
এ শাড়ির উৎপত্তি মুর্শিদাবাদের বালুচর গ্রামে। এর পুনরুজ্জীবন ঘটান বিষ্ণুপুরের তাঁতশিল্পীরা।
এখনও বিষ্ণুপুরের বস্ত্রশিল্পের একটা বড় অংশ এই বালুচরী। তবে একটি পুরো
কাহিনির চিত্রণ এখন আর বালুচরীতে হয়ই না, জানালেন তাঁতশিল্পীরা। |
|
|
কী ভাবে যাবেন |
হাওড়া থেকে ট্রেনে বিষ্ণুপুর স্টেশনে নেমে গাড়ি, অটো বা রিকশা।
|
কোথায় থাকবেন |
সরকারি-বেসরকারি বহু থাকার জায়গা। |
কখন যাবেন |
সারা বছরই যাওয়া যায়। যেতে পারেন বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২৩ থেকে ২৭ ডিসেম্বর
বিষ্ণুপুর মেলায়। এ ছাড়া ২৮ থেকে ৩০ ডিসেম্বর রাজ্য পর্যটন দফতরের উদ্যোগে হয় বিষ্ণুপুর উৎসব। |
|
|
|
|
|
|
|