জীবন-মণ্ডপে
অন্য দশভুজা
প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম এ দিয়েই বোধ হয় পার করা যায় সমস্ত বাধা। একের পর এক গণ্ডি পেরিয়ে অসম্ভবকে করে তোলা যায় সম্ভব। গল্প নয়, বাস্তবেও মিলল এমন মানুষের সন্ধান। সম্প্রতি পুজোর প্রস্তুতির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এমনই কয়েক জন মহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল বড়িশা ক্লাব। বাস্তব জীবনে এঁরা দশভুজা।
সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন প্রফুল্লকানন দেশপ্রিয় বিদ্যামন্দিরের ইতিহাসের শিক্ষক সোনালি পাণি। যিনি নিজে দৃষ্টিহীন। কিন্তু পড়ান সাধারণ স্কুলে। বছর ২৮-এর সোনালি জানালেন, মা ছাড়া বাড়িতে রয়েছেন তাঁর দৃষ্টিহীন দাদাও। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবার মৃত্যুর পরে অভাবের জেরে সবাই মিলে আত্মহত্যা করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু সাহস করে বেহালা ক্যালকাটা ব্লাইন্ড স্কুল থেকে ২০০০ সালে মাধ্যমিকে দৃষ্টিহীন মেয়েদের মধ্যে হয়ে গেলেন প্রথম। আর ফিরে তাকাননি। বেহালা বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর হন। তবে পড়াবেন কী করে, এ নিয়ে প্রথমে একটু ভয়ই পেয়েছিলেন সোনালি। জানালেন, শিক্ষক থেকে ছাত্র সকলেই সহায়তা করেছিলেন।
সম্মাননা অনুষ্ঠানে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় ও সনাতন দিন্দা। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
সোনালি ছাড়া ওই দিনের অনুষ্ঠানে সম্মান অর্পণ করা হয় মায়া বিশ্বাস, নির্ঝরিণী চক্রবর্তী এবং লিপি বণিককে। নিজের বাড়ির গ্যারাজেই প্রথম মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেমেয়েদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন বছর ৬০-এর মায়াদেবী। বলছিলেন, “তিন ছেলের মধ্যে দু’জনই মানসিক ভারসাম্যহীন। প্রথমে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি না থাকলেও ছেলেরা যাতে অন্তত নিজেদের কাজটুকু নিজেরা করতে পারে তাই এই পথে চলা। অন্য মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেমেয়েদের সাহায্যও করতে চাই।” সেই চাওয়া থেকেই সখের বাজারে নিজের বাড়ির গ্যারাজেই শুরু করেন একটি প্রতিষ্ঠান। নিজে হাতে সব সামলাতে প্রশিক্ষণও নিতে শুরু করেন। মাত্র তিন জনকে নিয়ে শুরু করলেও এখন তাঁর প্রতিষ্ঠানে ২২ জন ছেলেমেয়ে। আছেন ৭-৮ জন শিক্ষকও। রোজ শেখানো হয় গান, নাচ, আঁকা, হাতের কাজ। জানা গেল, এখানকার নাচের দলটি বাইরেও অনুষ্ঠান করে।
নির্ঝরিণীদেবীর কাহিনিটিও অদ্ভুত। বাবা অবসর নেওয়ার পরে খুব ছোট বয়সেই কাঁধে চেপে বসে গোটা সংসারের দায়িত্ব। তাই বাড়িতেই পড়ানো আরম্ভ করেন। বছর ৫৮-র নির্ঝরিণীদেবী জানালেন, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পরে নিজের স্কুল কাঁচরাপাড়া পলিটেকনিক বালিকা বিদ্যালয়ে যোগ দেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে। পদোন্নতি হয়ে প্রথমে ক্লার্ক এবং পরে হেড ক্লার্ক। তবে সকালে চাকরির পাশাপাশি দুপুরে নৈহাটির ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজ ফর উইমেন্সে পড়াশোনা। ১৯৭৪-এ স্নাতক হয়ে নিজের স্কুলেই শিক্ষিকা। পাশাপাশি, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘এডুকেশন’-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেয়ে ১৯৮৬-তে নহাটা জে এন এম এস মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শেষ করেন গবেষণাও। এর পরে ফিরে আসেন নৈহাটি ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কলেজে। এ বার অধ্যক্ষ পদে। এক সময় ছিলেন স্কুল সার্ভিস কমিশনের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সদস্য। ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ছিলেন বিধানসভার সদস্যও। হিন্দমোটরের বাসিন্দা লিপি বণিকও দৃষ্টিহীন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করছেন। গানও করেন। এতটা পথ পেরিয়ে আসতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হলেও এগিয়ে যেতে চান তিনি।
মণ্ডপে দশভুজার পুজোর অনেক আগে এ ভাবেই জীবন-মণ্ডপের দশভুজাদের পুজো করল বড়িশা ক্লাব।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.