|
|
|
|
|
|
প্রতি পক্ষ |
মেধাবী বিদ্রূপে উজ্জ্বল...
আমি মার্কিন মুলুকের মুখোশ-পরা অদ্ভুতুড়ে হ্যালোউইন-এর
পাশে রেখেছি খাজুরাহোর বিভঙ্গকে। উদয় কে ধর-এর
মুখোমুখি শোভন তরফদার |
|
|
তাঁর যে শিল্পকাজের ছবিটি এই সাক্ষাৎকারের সঙ্গে মুদ্রিত, তা দিয়ে মোটেই উদয় কে ধর-এর ব্যক্তিগত উপস্থিতিকে ধরা যাবে না। সিমা-র সাম্প্রতিক প্রদর্শনী ‘অদ্ভুতম্’-এর অন্তর্ভুক্ত এই ছবিটি তীব্র। বর্ণিল। এবং, একটি মেধাবী বিদ্রূপের বিস্ফারে উজ্জ্বল।
অন্য দিকে, শহরের একটি সুরম্য হোটেলের লাউঞ্জে যখন হেঁটে এলেন বিরলকেশ, যৌবন-পেরিয়ে-যাওয়া শিল্পী, দেখা গেল তাঁর উপস্থিতিটি স্মিত এবং অনুগ্র। হাসিটিও ততোধিক মৃদু।
বিশ্বায়নের ভূগোল আক্ষরিকই আত্মস্থ করেছেন উদয়। পিতামাতা ভারতীয়, কিন্তু জন্ম ব্রিটেনে। তার পরে, তিন থেকে বারো বছর, অর্থাৎ জীবনের সবচেয়ে গ্রহিষ্ণু সময়ে তিনি ভারতে। পটনায়। তার পরে বাবা মা-র সঙ্গে পাড়ি দেবেন আমেরিকা। আবার, বড় হওয়ার পরে জীবনের বেশ খানিকটা কাটাবেন বার্লিনে, কিন্তু, পাকাপাকি ডেরা বাঁধবেন আমেরিকাতেই, নিউ ইয়র্কে। অর্থাৎ, আন্তর্মহাদেশীয় বুনোটে বাঁধা তাঁর জীবন। সেই জীবন ঘিরে নানা রকম গল্প। স্থান ও কালের সঙ্গে নানা টুকরোটাকরার সঙ্গে জুড়ে থাকা গল্প। সেই সব গল্পই হল তাঁর সঙ্গে, দীর্ঘক্ষণ। আর গল্পের মাঝে, তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হল, আচ্ছা, একেবারে মৌলিকতা, মানে পরিভাষায় আমরা যাকে অরিজিনালিটি বলতে পারি, সেই জিনিসটা আপনার চোখে কী রকম?
ইন্টারেস্টিং, কিন্তু হঠাৎ এ কথা?
উদয় হাসলেন।
কারণ, আপনার দেখার চোখ তো একটা নয়। অনেক। সত্যিই অনেক। আপনার বেড়ে ওঠার মধ্যে যত রকম সংস্কৃতির ছায়া এসে পড়েছে, ততগুলি দিক থেকে জীবনকে দেখেছেন আপনি। ফলে, আপনার দৃষ্টিকোণের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
এই অরিজিনালিটি জিনিসটা খুব মজার, জানেন, কফিতে চুমুক দিলেন উদয়, শিল্পী হিসাবে আমি এটুকু প্রথমেই বলে নিতে চাই যে, আমার মধ্যে অনেকগুলো ধারা এসে মিশেছে, সেগুলোকে আমি স্বীকার করতে চাই। সেটাই শিল্পী হিসাবে নিজের কাছে নিজের ছবি। আর যদি অরিজিনালিটি-র কথা যদি বলেন, তা হলে বলব এই জিনিসটা নিয়ে ভারতে আর আমেরিকায় সম্পূর্ণ দু’রকম মনোভাব।
মানে? |
|
ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ |
মানেটা সহজ। ভারতে ‘মৌলিক’ বললে প্রথমেই যে ছবিটা চোখে ভাসবে, তা আর যারই হোক, খুব একটা বিদ্রোহীর ছবি মোটেই নয়। এ দেশে কয়েকটা ধাঁচ গড়া আছে। দেবমূর্তির মতো। সেই ধাঁচগুলো আস্তে আস্তে সমাজের মধ্যেও চারিয়ে যায়। অধিকাংশ মানুষ মুখে ততটা না হোক, অন্তত মনে মনে প্রত্যাশা করেন যে, সেই ধাঁচগুলো মেনে চলা হবে। ফলে, ‘মৌলিক’ হতেই হবে, সেই রকম একটা চাহিদা ততটা আমাদের বিব্রত করে না।
উদয়কে বলা হল না, একদা আমাদেরই মহাকবি কোনও এক অদ্ভুত মায়ার খেলাবশত এক বিদ্রোহীকে নিয়ে এসেছিলেন সাহিত্যক্ষেত্রে, যিনি রীতিমতো তাল ঠুকে বলেছিলেন, ফজলি আমের পরে আর একখানা ফজলিতর আম দিয়ে আর কী হবে, বরং আতা হলেই ভাল।
নিবারণ চক্রবর্তীর কথা হয়তো শেষটায় উঠেই পড়ত, কিন্তু উদয়ই মৌন ভাঙলেন, বললেন, আমেরিকায় ছবিটা উল্টো। সেখানে সবাইকে মৌলিক হতেই হবে। এই চাপটা সাংঘাতিক। তোমার কাজ যেন কারও মতো না হয়। সারাক্ষণ আপনার ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে একটা শঙ্কা, নিজের মতো হল তো? অন্য কারও মতো হয়ে গেল না তো?
মানে, এটা নয় এটা নয়, অন্য কিছু, অন্য কোনওখানে...
উদয় কে ধর হাসলেন, বললেন, তার মানে এই নয় যে ওখানে যা কিছু হচ্ছে, সবই একেবারে খাঁটি মৌলিক। মোটেই নয়। কিন্তু, মনোভাবের একটা ফারাক আছে। আপনি যে দৃষ্টিকোণের কথা বলছিলেন, তাতে একটা তফাত আছে। আপনার ঐতিহ্যের সঙ্গে, বলতে পারেন নিজের অতীতের সঙ্গে আপনি কী ভাবে আপনার সংলাপ চালাবেন, সেখানেই ফারাক। বড় ছবিটা এই যে, কোথাও ঐতিহ্যকে প্রায় প্রশ্নহীন ভাবে গ্রহণ করা, কোথাও আবার ঐতিহ্যের দিকে ক্রমাগত প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া। আপনি কোনটা চান, তা আপনাকেই ঠিক করতে হবে। ধরুন, যদি অতীত কোনও একটা স্থিতাবস্থা তৈরি করে দেয়, আপনি কী ভাবে তার মোকাবিলা করবেন, সেটাই দেখার বিষয়।
অনেকটা কথা বলে উদয় ঈষৎ থামতেই প্রশ্ন করা হল, এই মোকাবিলা তো আপনাকেও করতে হয়। তখন আপনি কী ভাবে
মোকাবিলা করেন?
উদয় তাঁর শিল্পকাজটির দিকে তাকালেন। বললেন, এই ছবিটা কী জানেন, এটা আসলে খাজুরাহো মিটস হ্যালোউইন...
অর্থাৎ, অনেকগুলো স্থান আর কাল জুড়ে আছে এর মধ্যে।
ঠিক। আমি মার্কিন মুলুকের মুখোশ-পরা অদ্ভুতুড়ে হ্যালোউইন-এর পাশে রেখেছি খাজুরাহোর বিভঙ্গকে। সেখানে একটি পুরুষ মূর্তির পাশে সাধারণত দু’টি নারী দেখা যায়।
আমি সেই ছকটা বদলে দিয়েছি, এখানে নারীমূর্তিটির পাশে দু’টি পুরুষ। তাদের মুখ-ঢাকা মুখোশে...
এই মুখোশটাও কি আপনার একটা ‘কমেন্ট’-এর মতো নয়? পরিচয়ের সঙ্গে অপরিচয়কে বুনে দেওয়া, অস্তিত্বের ধারণাটা নিয়ে একটা মজাদার খেলা?
উদয় হাসলেন, খেয়াল করে দেখুন, এই নারীমূর্তির আদলে, বা আরও বড় অর্থে ধরলে তিনটি অবয়বের সামগ্রিক বিভঙ্গে আছে বলিউডি ছায়া। কারণ, এখন বলিউড এমনই একটা প্রভাব যাকে অস্বীকার করা যাবে না।
বলা হল, আপনি কি দেখেছেন, সম্প্রতি ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ নামের একটি ছবি সাড়া জাগিয়েছে বলিউডে?
উদয় জানালেন, হ্যাঁ, খেয়াল করেছেন।
যদি আপনার এই ছবিটিকেই এখানে কেউ বলে, ডার্টি পিকচার? এ আবার কী রে বাবা?
শিল্পীর হাসিটি আরও একটু চওড়া হল। তিনি হাসতেই হাসতেই বললেন, ভাল তো, বলুক না। আমি উত্তরে বলব, নিজের দিকে তাকান, দেখবেন এমন অজস্র কিছু ভেসে আছে, জেগে আছে আমাদের মধ্যে। তাদের কি খেয়াল করি আমরা? আমরা কি দেখতে চাই কী ভাবে, সংস্কৃতির নানা আনাচকানাচের মধ্যে চলছে সংলাপ? দেখতে না চাইলে ভুলে থাকাই যায়, কিন্তু তা বলে এই সংলাপটাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
উদয় কে ধরের সঙ্গে আড্ডা আরও অনেকক্ষণ চলেছিল। সেই বৃত্তান্ত এখানে অপ্রয়োজনীয়। শুধু উল্লেখ থাক যে তিনি দূরে থেকেও জড়িয়ে আছেন নিজের সঙ্গে।
শিকড়ের সঙ্গে।
শুধু, শিকড়টাই যদি খুঁজে পাওয়া যেত!
বহুবচন, বহুবচন, কফির কাপে অন্তিম চুমুকটি দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন উদয় কে ধর। অনেকটা নিবারণ চক্রবর্তীর মতো। |
|
|
|
|
|