প্রশান্ত পাল • পুরুলিয়া
শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল • আদ্রা |
পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে পাঁচশোর বেশি রোগী থাকেন। আগুন নেভানোর সিলিন্ডার রয়েছে মাত্র দু’টি।
রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতালে প্রায় ১৫০ জন রোগী রয়েছেন। সেখানেও দু’টি সিলিন্ডারই ভরসা।
জেলার নার্সিংহোমগুলির আগুন নেভানোর পরিকাঠামোও তথৈবচ। কলকাতার আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পরে জেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির অবস্থা খোঁজ নিতে গিয়ে এই ছবিই দেখা গিয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য দফতর থেকে জেলা প্রশাসন-সকলেই আশ্বাস, এ বার পরিস্থিতি বদলাবে। গড়ে তোলা হবে আগুন নেভানোর পরিকাঠামো।
পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতাল চার তলার। দোতলার লিফটের অদূরে রয়েছে অপারেশন থিয়েটার। কিছুটা দূরে প্রসূতি বিভাগ। দোতলার এ প্রান্ত ও প্রান্ত ঘুরে চোখে পড়ল না কোনও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। অথচ এই দোতলাতেই কিছু দিন আগে আগুন লেগেছিল। রোগীর আত্মীয়দের অভিযোগ সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তিন তলায় শিশু বিভাগ। এখানে রয়েছে রাজ্যের মডেল নবজাত শিশুদের বিশেষ পরিচর্চা কেন্দ্র। বারান্দার এক দিকে পুরুষ শল্য বিভাগ। এখানেও আগুন নেভানোর কোনও সরঞ্জাম চোখে পড়ল না। উপরন্তু, শিশু বিভাগের দরজার কাছে মেঝেতে পড়েছিল অক্সিজেনের কয়েকটি সিলিন্ডার। দোতলাতেও প্রসূতি বিভাগের দরজার কাছেও একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। নানা প্রয়োজনে যাঁরা মাঝে মধ্যে হাসপাতালে আসেন তাঁদের অভিযোগ, রোগীদের আত্মীয়-স্বজনেরা সিলিন্ডারের পাশে বসে ধূমপানও করেন। এক নার্সের কথায়, “একে হাসপাতালের ভিতরে ধূমপান করতে মানা। তার উপরে সিলিন্ডারের কাছে ধূমপান বিপজ্জনক। কিন্তু আমরা নিষেধ করলে শুনবে কে?” হাসপাতাল সুপার স্বপন সরকার দাবি করেছেন, “খালি সিলিন্ডার মাঝে মধ্যে বারান্দায় পড়ে থাকে। তবে সেখানে ধূমপান করা উচিত নয়। বিড়ির আগুন থেকে তো বিপদ ঘটতেই পারে।” |
এই ভাবেই পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে যত্রতত্র পড়ে রয়েছে অক্সিজেনের সিলিন্ডার। ছবি: সুজিত মাহাতো। |
বিপদের আরও কারণ রয়েছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, হাসপাতালের কোথাও ফায়ার অ্যার্লাম নেই। সময় মতো আগুন নজরে না এলে সমূহ বিপদ। এখন এক তলা থেকে চার তলা পর্যন্ত ওঠানামার একটিই মাত্র সিঁড়ি রয়েছে। রয়েছে দু’টি লিফট। স্বাস্থ্যকর্মীদের আশঙ্কা, “অগ্নিকাণ্ডের মতো বিপদ ঘটলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে লিফট বন্ধ হয়ে যাবে। ভরসা তো তখন একটিই সিঁড়ি! এত রোগী-স্বাস্থ্যকর্মী নীচে নামবে কী করে?” হাসপাতাল সুপার স্বপন সরকার জানান, নবজাত শিশুদের বিশেষ পরিচর্চা কেন্দ্রের ভিতরে আগুন নেভানোর মাত্র দু’টি সিলিন্ডার রয়েছে। হাসপাতালের আরও কোথাও অগ্নিনির্বাপণের কোনও যন্ত্র নেই। অর্ন্তর্বিভাগ থেকে দূরে রান্নাঘর থাকলেও সেখানেও অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই । নেই দমকলের লাইসেন্সও। তাই রোগীর আত্মীয়দের অভিযোগ, “পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল তো জতুগৃহ!” হাসপাতাল সুপারের আশ্বাস, “আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য শীঘ্রই উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে। সে জন্য পূর্ত, বিদ্যুৎ ও দমকল বিভাগের আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করে পরামর্শ নেওয়া হবে।”
রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতালেও খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, তাদেরও ‘ফায়ার লাইসেন্স’ নেই। সদর হাসপাতালের মতোই এখানকার অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থাও ঢিলেঢালা। বর্হির্বিভাগেও কয়েকশো রোগী আসেন। কিন্তু অগ্নিনির্বাপণের জন্য মাত্র দু’টি সিলিন্ডার রয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশ জানান, ওই সিলিন্ডার দু’টি কবে নিয়ে আসা হয়েছিল তা জানা নেই। হয়ত মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণও নেই। তাঁদের আক্ষেপ, স্টেট জেনারেল থেকে মহকুমাস্তরে এই হাসপাতালে অনেক বছর আগে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু রোগীদের নিরাপত্তাজনিত পরিকাঠামো এখনও গড়ে তোলা হয়নি। হাসপাতাল ঘুরেও চোখে পড়েছে বিপজ্জনক ছবি। ওয়ার্ডগুলির ভিতরে বিদ্যুতবাহী তার ঝুলছে। হাসপাতাল চত্বরেই রয়েছে রান্নাঘর। সেখানেও আগুন নেভানোর কোনও ব্যবস্থা নজরে আসেনি। আগুন নেভানোর ঢিলেঢালা ব্যবস্থার কথা স্বীকার করেছেন খোদ হাসপাতালের সুপার সুভাষচন্দ্র ঘাটা। তিনি বলেন, “ওর্য়াড, রান্নাঘর-সহ বিভিন্ন এলাকায় আগুন নেভানোর জন্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। শীঘ্রই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল ও রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতালের কাছে দমকল কেন্দ্র রয়েছে। দুই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, হাসপাতালে আগুন লাগলে দমকল দ্রুত পৌঁছে যাবে। কিন্তু রোগীর আত্মীয়দের প্রশ্ন, “সেই সময় দমকল অন্যত্র ব্যস্ত থাকলে বেহাল পরিকাঠামো নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী ভাবে রোগীদের বাঁচাবেন? পুরুলিয়া সদর হাসপাতালের সুপার বলেন, “আমরির ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আগুন লাগলে সত্যি আমরা অসহায়।”
কেমন রয়েছে বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি? পুরুলিয়া শহরের ওয়েস্টলেক রোডে তিনতলার একটি বেসরকারি চক্ষু হাসপাতাল রয়েছে। সেখান দোতলা ও তিন তলায় দু’টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রয়েছে। একটির মেয়াদ ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে উত্তীর্ণ হেছে। অন্যটির মেয়াদ ফুরনোর তারিখ ফিকে হয়ে যাওয়ায় পড়া যায়নি। বর্হির্বিভাগে দৈনিক কয়েকশো রোগী আসেন। হাসপাতালে ঢোকা ও বের হওয়ার একটিই পথ। ‘ফায়ার অ্যালার্ম’ও নেই। কর্তৃপক্ষের তরফে পীযূষ মুখোপাধ্যায়ের জবাব, “আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি অনেক। আগেই আমাদের সচেতন হওয়া উচিত ছিল। দমকল বিভাগের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” বোকারোর চাষের বাসিন্দা বিহারীলাল সাহু’র স্ত্রী-র এখানে চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়। এখানকার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার কথা শুনে তিনি বলেন, “কলকাতার অবস্থা দেখে রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছি।” বরাকর রোডের একটি নার্সিংহোমে গিয়ে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা দেখা যায়নি। নার্সিংহোমের মালিক অসীম রায় বলেন, “অগ্নিনির্বাপণের কোনও সরঞ্জাম নেই।” তাঁর দাবি, “স্বাস্থ্য দফতর কোনও দিন এসব রাখার জন্য আমাদের বলেনি। তবে এ বার আমরা আগুন নেভানোর সরঞ্জাম রাখার কথা ভাবছি।” দমকল দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “আগুন নেভানোর সরঞ্জাম রাখা বাধ্যতামূলক। রোগীদের স্বার্থে হাসপাতাল-নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের সবার আগে আগুন নেভানোর সরঞ্জাম রাখা উচিত।”
পুরুলিয়া দমকল কেন্দ্রের ওসি সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “সদর হাসপাতাল-সহ পুরুলিয়া শহরের নার্সিংহোমগুলির ফায়ার লাইসেন্স নেই। আমাদের সদর দফতর থেকে কয়েক বছর আগে জেলা স্বাস্থ্য দফতরকে এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তা সত্বেও পরিস্থিতি বদলায়নি।” জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক নিশিকান্ত হালদার বলেন, “আগুন নেভানোর ব্যবস্থায় কিছু ঘাটতি রয়েছে। কোথায় কেমন ব্যবস্থা রয়েছে তা খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” জেলাশাসক অবনীন্দ্র সিংহ বলেন, “সমস্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সব কিছু পুনরায় খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে পরিদর্শনও করা হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।” |