আয় বাড়াতে ইতিমধ্যেই সরকারের সমস্ত দফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কর্মী কম থাকায় মাথায় হাত পড়েছে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের। পরিকাঠামোর সমস্যা এই দফতরের আয় বৃদ্ধির বড় ‘অন্তরায়।’
জুটমিল, কারখানা, ইটভাটা, সরকারি লিজে থাকা জমি, বাস্তুজমি এমন হাজারো উৎস থেকে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর খাজনা আদায় করে। কিন্তু সে কাজ করার মতো লোকবল কোথায়?
রাজ্যে মোট ব্লক ৩৪১টি। খাজনা তোলার জন্য পুর-এলাকায় ভূমি সংস্কার (এলআর) এবং পঞ্চায়েত এলাকায় রাজস্ব পরিদর্শক (আরআই) অফিস থাকে। এই সব অফিসে অন্তত এক জন আরআই, এক জন আমিন, এক জন ভূমি সহায়ক এবং এক জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী থাকার কথা। কিন্তু কর্তারা জানান, খাজনা আদায়ের জন্য প্রয়োজনের অর্ধেক লোক রয়েছে তাঁদের। বেশির ভাগ জায়গায় ওই দু’টি অফিস এক জন রাজস্ব পরিদর্শককেই সামলাতে হয়।
আরামবাগের কথাই ধরা যাক। এখানে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের ভাড়া বাড়িতে মাত্র একজন কর্মী সপ্তাহে তিন দিন খাজনা নেন। লোডশেডিং হয়ে গেলে খাজনা নেওয়া বন্ধ থাকে। কারণ, আধো-অন্ধকার দফতরে কোনও জেনারেটর নেই। এই এক জন কর্মীই আরামবাগ পুরসভার ১৮টি ওয়ার্ডের খাজনা নেন। তাঁকেই পুরসভা বাদে লাগোয়া পঞ্চায়েতের কয়েকটি মৌজাতেও খাজনা নিতে হয়। গৌরহাটি-১ পঞ্চায়েতের ডিহিবাবনানের বাসিন্দা শেখ আবুনাসার বলেন, “আমার জমির মিউটেশন হয়নি। ২০০৪ সাল থেকে খাজনা দেওয়ার জন্য ঘুরছি। দফতর থেকে জানিয়েছে, কর্মী নেই। দেরি হবে।’’ শেখ জিকরিয়ার বাড়ি আন্দি মহল এলাকায়। তিনি বলেন, “খাজনা দিতে গেলে দফতর থেকে বলছে কর্মী নেই। হিসাব করার সময় নেই। এখন খাজনা নেওয়া যাবে না।”
আমতার সন্তোষনগরে বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে তাঁদের এলাকা থেকে অবাধে মাটি তোলা হচ্ছে। ফুটবল মাঠ, গ্রন্থাগার, পার্ক-সহ ৫০-৬০ বিঘা জমি ইতিমধ্যেই তলিয়ে গিয়েছে নদীর গর্ভে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের বক্তব্য, কর্মী নেই। বেআইনি মাটিকাটায় নজরদারি করবে কে? কোলাঘাটে রূপনায়ারণ নদ বা আমতায় দামোদরের চর থেকে বালি তোলার ব্যবসায় ১০০ ঘনফুট বালির জন্য ৭৮ টাকা আগাম জমা দিতে হয় ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে। অনেকে সেই টাকা দেন ঠিকই। কিন্তু বালি তোলেন অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রেও নজরদারির অভাব। হুগলির উত্তরপাড়া থেকে বলাগড় পর্যন্ত গঙ্গার ধার বরাবর কয়েকশো ইটভাটা রয়েছে। শুধু উত্তরপাড়ারই ১১টি ভাটা থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকা তাদের পাওনা রয়েছে বলে জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের হিসেব। উলুবেড়িয়ার হীরাপুরে প্রতিদিন অবাধে গঙ্গার পাড় থেকে মাটি তুলে ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে। ‘মাটি-মাফিয়া’রা কিছু রাজনৈতিক নেতার ‘আশ্রিত’ তোলাবাজদের নৌকা-প্রতি দিনে এক হাজার টাকা করে দিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। সরকারি ভাঁড়ারে কানাকড়িও আসছে না। শ্যামপুরে দামোদরের ধারে ইটভাটার জন্য কাটা মাটি থেকেও সে ভাবে খাজনা মিলছে না বলে জানিয়েছেন দফতরের আধিকারিকেরা। এ ছাড়াও জমি-বাড়ির মালিক কিংবা বড় শিল্প সংস্থার থেকেও বহু টাকা বকেয়া আছে দফতরের। বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া বা পশ্চিম মেদিনীপুরের পাথর-খাদান থেকেও রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে মামলা-জনিত সমস্যা। বহু ক্ষেত্রে খাজনা নিয়ে মামলা করা হচ্ছে। তা মিটতে সময় লাগছে।
সরকারি সূত্রে খবর, রাজ্য জুড়ে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কোটি কোটি টাকা অনাদায়ী। সঠিক পরিমাণও জানা নেই। ‘পশ্চিমবঙ্গ ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক সমিতি’র সম্পাদক প্রদীপ রায় বলেন, “পরিকাঠামো নেই। কর্মী নেই। কাজের জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ জোরালো আইন নেই।” ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কর্মী ও আধিকারিকদের একাংশের অভিযোগ, একে কর্মী কম। তার উপরে কোথাও খাজনা আদায় করতে গিয়ে বাধা-মারধরের মুখেও পড়তে হয়। এ সব কারণেই কর্মীরা খাজনা আদায়ে উৎসাহ হারান। কর্মীদের পদোন্নতির সুযোগ কম। সে জন্যও বহু ক্ষেত্রে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ আদায়ের কাজে উৎসাহ পান না বলে অনেক কর্মীর অভিযোগ। রাজ্যের ভূমি-সচিব আর ডি মিনা বলেন, “পরিকাঠামোর উন্নতি হলে রাজস্ব আদায় বাড়বে।” কিন্তু পরিকাঠামোর উন্নতি কী ভাবে হবে, তা নিয়ে নিরুত্তর সচিব। পরিকাঠামোর উন্নয়ন নিয়ে বিশেষ কোনও পরিকল্পনা এই মুহূর্তে না থাকলেও রাজস্ব বাড়াতে দু’টি পথের কথা ভেবেছে রাজ্য। প্রথমত সরকারি নিয়ম অনুয়ায়ী খাদান থেকে বালি, পাথর বা মোরামের মত ছোট মাপের খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য ‘লিজ’ এর বিনিময়ে ‘সেস’ বা ‘রয়্যালটি’ নেওয়া হয়। সরকার ঠিক করেছে, এই সেস বা রয়্যালটির অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত বর্তমান নিয়ম অনুয়ায়ী খাদান লিজ দেওয়ার জন্য ‘আগে এলে আগে পাওয়া যাবে’ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। সরকার ঠিক করেছে, এ বার থেকে পুরনো পদ্ধতি বাতিল করে খাদানের খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য ‘নিলাম’ করা হবে। রাজ্য সরকারের এক মুখপাত্র জানান, এই দুই পদ্ধতি চালু হলে আয় নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। গত আর্থিক বছরে আয় হয়েছিল ৪০০ কোটি টাকা। রাজস্ব বাবদ এই আয় ৬০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে। |