মৃতের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সাম্প্রতিক অতীতে বিষ-মদের এমন চেহারা পশ্চিমবঙ্গ দেখেনি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ করে কেন এমন ‘হন্তারক’ হয়ে উঠল চোলাই মদ? কী ছিল তাতে?
পুলিশ জানিয়েছে, ময়নাতদন্তে মৃতদের পেট থেকে মিথাইল অ্যালকোহল বা মিথানল মিলেছে। যা অত্যন্ত মারাত্মক বিষ বলে জানিয়ে ময়নাতদন্তকারীরা দাবি করেছেন, চোলাই খাওয়ার ফলেই এই ‘বিষ’ তাদের শরীরে ঢুকেছিল।
কিন্তু চোলাইয়ে মিথাইল অ্যালকোহল এল কী ভাবে?
আবগারি দফতর সূত্রে খবর, সাধারণত, শর্করা জাতীয় উপাদান পচিয়ে তার থেকে ইথাইল অ্যালকোহল প্রস্তুত করা হয়। এর সঙ্গে শ্বেতসার বা কার্বোহাইড্রেট (মূলত পচা ভাত) মিশিয়ে তৈরি হয় দিশি মদ। কিন্তু চোলাইয়ের ক্ষেত্রে অন্য ব্যবস্থা। এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেশার মাত্রা বাড়াতে ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে মিথাইল অ্যালকোহল, সোরা এমনকী কীটনাশকও মেশানো হয়। যাতে কম খরচেই বেশি নেশা হয়। মিথাইল অ্যালকোহল চলতি ভাষায় কাঠ পালিশের স্পিরিট বা মিথানল বলেই পরিচিত। বিজ্ঞানীরা জানান, মিথানল হল স্পিরিটের সব থেকে অশোধিত পর্যায়। সাধারণ অবস্থায় এটি হাল্কা, বর্ণহীন, দাহ্য এবং উগ্র গন্ধযুক্ত হয়। স্বাদে অত্যন্ত মিষ্টি। মূলত কাঠ পালিশ, প্লাস্টিক, রঙ, প্লাইউড এবং ছাপা শিল্পেই এটি ব্যবহৃত হয়। এই মিথানল মানবশরীরে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। মগরাহাটে সেটাই ঘটেছে বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ।
কী ভাবে তৈরি হয় চোলাই?
আবগারি ও পুলিশ সূত্রের খবর, চোলাইয়ের ভাটিগুলিতে ঘরোয়া প্রক্রিয়ায় প্রথমে চিটেগুড় বা চিনির গাদ (মোলাসেস) পচিয়ে ইথাইল অ্যালকোহল তৈরি হয়। পচানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ইস্ট। হাঁড়ির ভিতরে পচা গুড় বা মোলাসেস রেখে তার উপরে জল ঢেলে ‘পাতন’ প্রক্রিয়ার সাহায্যে ইথাইল অ্যালকোহল তৈরি হয়। মেশানো হয় পচা ভাতও। শেষে যোগ করা হয় মিথাইল অ্যালকোহল, কীটনাশক ইত্যাদি।
সকালে মগরাহাটের পূর্ব ও পশ্চিম পাঁচগাছিয়া এলাকায় চোলাইয়ের ভাটি ভাঙতে গিয়ে পুলিশ দেখে, এলাকায় ছোট ছোট পুকুরে গুড় পচানো হচ্ছে। আর পাশের পুকুরের কালো জলে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে চোলাইয়ের ড্রাম। ওই এলাকার এক বাসিন্দা জানান, ওই ড্রামেই পরে মেশানো হবে মিথাইল অ্যালকোহল বা মিথানল।
পুলিশ জানিয়েছে, এ ধরনের ভেজাল রুখতে মিথানলে এখন নীল রং দেওয়া হয়। ঘোলাটে-সাদা রঙের চোলাইয়ে নীল রংয়ের মিথানল মেশানো হলে তার রংও পাল্টে যাবে। সহজেই ভেজাল ধরা পড়ার কথা। তা হলে ধরা পড়ছে না কেন?
আবগারি দফতরের অফিসারদের দাবি, চোলাইয়ের ক্ষেত্রে যে ভাবে মিথানল মেশানো হয়, তা অনেকটা এক পুকুর জলে এক দোয়াত কালি মেশানোর সামিল। তাই রঙের পরিবর্তন অতটা ধরা পড়ে না।
কিন্তু ওই সামান্য মিথানল মেশালে কি কারও মৃত্যু হতে পারে?
চিকিৎসকেরা জানান, মিথানল এতটাই বিষাক্ত যে মাত্র ১০ মিলিলিটার শরীরে ঢুকলে সেই ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যাবেন। আর ৩০ মিলিলিটার ঢুকলে মৃত্যু নিশ্চিত। তাঁদের বক্তব্য, মিথানল থেকে দু’ভাবে বিষক্রিয়া ছড়াতে পারে। এক, শুঁকে অথবা চামড়ার মাধ্যমে। যার ফলে হাঁপানি বা স্নায়ুর রোগ দেখা দিতে পারে। দুই, ওই রাসায়নিক পান করলে। তদন্তকারীদের দাবি, মগরাহাটের ঘটনায় দ্বিতীয় পদ্ধতিতেই বিষক্রিয়া ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, শরীরে মিথানল ঢুকলে পরিপাকের মাধ্যমে তা ফরম্যালডিহাইড এবং পরে ফরমিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এর থেকে বিষক্রিয়ায় কোষে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যার নাম হাইপোক্সিয়া। দেখা দেয় মাথাব্যথা, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনির মতো উপসর্গ। শরীরে অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে গেলে কিডনি তা শরীর থেকে বার করে দিতে পারে না। ফলে কিডনি অকেজো হয়। স্নায়ুতন্ত্র ও যকৃৎ-সহ পেটের অন্যান্য প্রত্যঙ্গেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়।
সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, “চোলাইয়ে মিথাইল এবং ইথাইল অ্যালকোহল মিশে যাওয়ার ফলে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র এবং ফুসফুস বিকল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে যকৃতের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েও মৃত্যু হয়।” বুধবার মগরাহাটে যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই উপসর্গ দেখা গিয়েছিল।
চিকিৎসকদের আশঙ্কা, বিষ মদে যাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, মারা না-গেলেও অনেকে চিরকালের মতো অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। চোখের স্নায়ুর উপর চোলাইয়ের বিষক্রিয়ার মারাত্মক প্রভাব পড়ে বলে তাঁরা জানান।
|