বহু মানুষের মৃত্যুজনিত ট্র্যাজেডি রাজ্য রাজনীতিতে যে ‘সহযোগিতা ও ঐক্যের’ পরিবেশ এনে দিয়েছিল, বিষমদ কাণ্ডে ভেঙে পড়ল সেই বাতাবরণ। সৌজন্যে সরকার পক্ষের একটি ‘আচমকা’ মন্তব্য!
আমরি-কাণ্ডের মতো বিষমদে মৃত্যুমিছিলের ঘটনাতেও রাজ্য সরকার এবং বিরোধী শিবির প্রাথমিক ভাবে ‘সহযোগিতার’ পথেই হাঁটছিল। বৃহস্পতিবার দুপুরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় ঘোষণা করেছিলেন, দোষীদের খুঁজে বার করার সময় কোনও ‘দলের কথা’ ভেবে কাজ করা হবে না। তাঁর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএম বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা বলেছিলেন, সিপিএম বা তৃণমূল না-দেখে দোষীদের গ্রেফতার করুক সরকার। সেই সহমতের বাতাবরণই সন্ধ্যায় বদলে গেল, যখন শিল্প ও পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সরাসরি সিপিএম-কে ‘বিষমদের ঘটনার নায়ক’ বলে অভিহিত করলেন। তাঁর অভিযোগ, ‘পরিকল্পনামাফিক’ চোলাই মদের সঙ্গে রাসায়নিক মিশিয়ে সিপিএমের স্থানীয় নেতারাই এত মানুষের মৃত্যু ডেকে এনেছেন!
‘পরিকল্পনা’র ব্যাখ্যা করে তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা পরে জানান, আমরি-র ঘটনায় যে ভাবে তোদিদের সঙ্গে সিপিএম জড়িয়ে পড়েছিল, তা থেকে ‘নজর ঘোরাতেই’ ওই কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তাঁর কথায়, “আমরি নিয়ে সিপিএম ক্রমশই বিব্রত হচ্ছে। সেই বিড়ম্বনা চাপা দেওয়ার জন্য এই কাণ্ড ঘটানো হল না তো? নইলে কী করে এত গায়ে-গায়ে এই দু’টি ঘটনা ঘটল?”
তৃণমূল শিবিরের এই অভিযোগ চোলাই মদ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবিত সর্বদল বৈঠকের উপরে ছায়া ফেলবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিষমদকে ‘সামাজিক সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করে তার মোকাবিলায় সব দলের মতামত চেয়েছেন মমতা। এ দিনই বিধানসভায় তিনি জানান, আগামী সোমবার স্পিকারের পৌরোহিত্যে সর্বদল বৈঠক বসবে। তার আগে এ দিনই পার্থবাবুর ডাকে বিধানসভায় তাঁর ঘরে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। ভূমি বিল সংক্রান্ত কিছু ‘জটিলতা’ এবং শীত অধিবেশনে লাগাতার কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি চোলাইয়ের রমরমা বন্ধে লাইসেন্সকৃত দেশি মদের দোকান ও জোগান বাড়ানোর প্রস্তাব ঘরোয়া ভাবে সরকারকে দেন তিনি।
কিন্তু পার্থবাবুর মন্তব্য সরকার-বিরোধী প্রকাশ্য সম্পর্কে তো বটেই, এই ‘ট্র্যাক টু’ যোগাযোগেও অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছে।
সর্বদল বৈঠকের দরজা বন্ধ না করলেও সূর্যবাবু পরে বলেন, “ঘরোয়া ভাবে কী বলছি, সেটা বড় কথা নয়। সরকার সর্বদলে কী বলে সেটা আগে দেখি।” সিপিএমের এক প্রাক্তন মন্ত্রী এবং বর্ষীয়ান বিধায়কের কথায়, “সরকারের খেলা আগে দেখি! তার পরে আমরা ঠিক করব, কী করব।”
মুখ্যমন্ত্রী যে দিন বিধানসভায় বিষ মদের ঘটনায় সিআইডি তদন্তের কথা জানিয়েছেন, সে দিন মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তিত্ব কী ভাবে এমন মন্তব্য করলেন তা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই সরব বিরোধী শিবির। বিরোধী দলনেতা ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়ে বলেছেন, তাঁরা সরকারকে ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ দিচ্ছেন। যাকে পারে গ্রেফতার করে সরকার তাদের অভিযোগ প্রমাণ করুক! সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু পার্থবাবুর মন্তব্যকে ‘মিথ্যা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন’ আখ্যা দিয়েছেন। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, “এটা তো বছরের সেরা রসিকতা!” আজ, শুক্রবার বিধানসভায় পার্থবাবুরই প্রশ্নোত্তর পর্বে জবাব দেওয়ার কথা। তাঁকে নিয়ে আজ বিধানসভা উত্তপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা।
পার্থবাবুর মন্তব্যের পিছনে রয়েছে প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবের কটাক্ষ। সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্মেলনের সমাবেশে রাজ্য সরকারকে ‘মড়ার সরকার’ বলে অভিহিত করে তিনি অভিযোগ করেছেন, রাজ্য সরকার শুধু মৃতদের নিয়ে ভাবছে (বিষ মদে ক্ষতিপূরণের প্রতি প্রচ্ছন্ন কিন্তু অবধারিত ইঙ্গিত-সহ) কিন্তু জীবিতদের সমস্যা সমাধানে কিছু করতে পারছে না।
এরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিজের ঘরে পার্থবাবু বলেন, “মানুষ উচিত শিক্ষা দিলেও সিপিএমের এক দঙ্গল নেতা তা গ্রহণ করেননি। শীত কালে যাঁদের আরও বেশি করে গর্তে থাকার কথা, তাঁরা হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে মানুষের হয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন! বিষমদের নায়ক হচ্ছেন সিপিএমের নেতারা! দায়িত্ব নিয়ে বলছি, যাঁরা এ সব কথা বলছেন, তাঁরাই পরিকল্পনামাফিক মদের সঙ্গে কোনও দ্রব্য মিশিয়ে মৃত্যুপথযাত্রীতে পরিণত করেছেন।” প্রাথমিক তদন্তে এমন কোনও ইঙ্গিত কি মিলেছে, যার ভিত্তিতে তিনি এ কথা বলছেন? পার্থবাবু বলেন, “যাঁরা দোষী, সিপিএমের সেই স্থানীয় নেতারা গা-ঢাকা দিয়েছেন কেন?”
এ দিন সভায় মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতির পর রেজ্জাক বলতে উঠেছিলেন, সংগ্রামপুরের ওই মদের ঠেকের ‘নাকের ডগায়’ পুলিশ ফাঁড়ি আছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে থামিয়ে বলেন, “চুপ করে থাকুন! আমি কোনও দল দেখে কিছু বলিনি। বাদশা খোকন কোন দলের লোক, আমি কিন্তু বলিনি। নিজের দলের খোঁজ নিন। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলের প্রভাব থাকলে পুলিশের অসুবিধা হয়।”
রেজ্জাক (যাঁকে এ দিন সংগ্রামপুরে যাওয়ার পথে আটকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ সিপিএমের) অবশ্য দাবি করেছেন, ওই বিষমদের ঠেকের মালিক হিসেবে যে বাদশা খোকনের নাম মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সে এখন তৃণমূলে ভিড়েছে। তাঁর কথায়, “এরা সিপিএমের লোক হলে আলিমুদ্দিনে এনে গুষ্টির পিন্ডি চটকাতাম। ওরা সব তৃণমূলে ঢুকেছে।” তাঁর আরও বক্তব্য, “নাম করছি না। ওই যে লোকটা সূর্যোদয় (নন্দীগ্রামে) থেকে সূর্যাস্তের সময় ছিল, সে-ও তো এখন তৃণমূলে! ধরতে অসুবিধা কী?” রেজ্জাক যে মগরাহাটের কুখ্যাত দুষ্কৃতী সেলিমের কথা বোঝাতে চেয়েছেন সেটা স্পষ্ট। নন্দীগ্রাম ‘পুনর্দখলের’ সময় সিপিএম যাকে ব্যবহার করেছিল বলে অভিযোগ তৃণমূলের।
রেজ্জাকের মন্তব্যের জবাবে পার্থবাবু বলেন, “ওই দোকান যে সিপিএম নেতারা চালাতেন, এদের দিয়ে ক্যাডার-বাহিনী তৈরি হত, এটা আর গোপন নেই। কেউ ছাড় পাবে না!” তাঁর এই ‘গুরুতর’ অভিযোগের জবাবে সূর্যবাবু পাল্টা বলেছেন, “এখন মনে হচ্ছে, ওঁদেরই কোনও ষড়যন্ত্র ছিল আমাদের নাম জড়িয়ে দেওয়ার জন্য। বিধানসভার ভিতরে মুখ্যমন্ত্রী এবং বাইরে রেজ্জাক যা বলেছিলেন, তাতে দলের পরিচয় না-দেখেই দোষীদের ধরার কথা ছিল। সরকারের সাহস থাকলে যাকে পারে, ধরুক! মন্ত্রী যা বলেছেন, তা প্রমাণ হোক!” আর এক প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমানের বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী তো বিধানসভায় বললেন সিআইডি তদন্ত হচ্ছে। তার মধ্যেই পরিষদীয় মন্ত্রীর এমন মন্তব্য! মুখ্যমন্ত্রীর উপর কি তাঁর ভরসা নেই? নাকি সিআইডি-তে ভরসা নেই?” পার্থবাবুর মন্তব্যের পরে বিরোধী শিবির থেকে আরও প্রশ্ন উঠেছে, আমরি-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে তৎপরতা সঞ্চার করেন, সেই সরকারই বিষমদ কাণ্ডে অন্য পথে হাঁটছে কেন? বিমানবাবুর কথায়, “এত লোক মারা গিয়েছেন। যখন প্রশাসনের তৎপরতা দেখানোর কথা, তখন এই কথা বলা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা!” বুধবার ঘটনাস্থল ঘুরে এসে রেজ্জাক এ দিনই বলেন, “হাসপাতালে দেখলাম জেলাশাসক, সিএমওএইচ, এসপি সব ঘর আলো করে বসে আছেন! জানতে চাইলাম, চিকিৎসাটা হচ্ছে কই? গাঁয়ে-ঘরে এমন হলে লোকে তেঁতুল জল খাওয়ায় (পাকস্থলী পরিষ্কারের জন্য)। এখানে মেডিক্যাল টিম আগে পৌঁছলে কিছু প্রাণ বাঁচত।” |