মোবাইলে ফোন করলেই ‘হোম-ডেলিভারি’। বাড়তি খরচও গুনতে হবে না।
মোবাইল না থাকলেও সমস্যা নেই। দুধওয়ালার মতো সাইকেল নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থাও রয়েছে।
ইদানীং পিৎজা বা বিরিয়ানি যে ভাবে গৃহস্থের বাড়িতে পৌঁছে যায়, চোলাই মদের বিপণন ব্যবস্থাকে সে রকমই আধুনিক চেহারা দিয়েছে নিউ ব্যারাকপুরের বিলকান্দার চোলাই-কারবারিরা। ঢালাও উৎপাদন এবং জোগানের এই উন্নত ‘নেটওয়ার্ক’ই এখানকার চোলাই ব্যবসাকে রাজ্য জুড়ে ‘পরিচিতি’ দিয়েছে।
ঘোলা থানা ও নিউ ব্যারাকপুর ফাঁড়ির অন্তর্গত বিলকান্দা ১ ও ২ পঞ্চায়েত এবং নিউ ব্যারাকপুর পুরসভার একাংশে চোলাইয়ের কারবার চলে। এক সময় এলাকাটি রাজ্যের প্রাক্তন অর্থ ও আবগারি মন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছিল। এখন ওই কেন্দ্র থেকে জিতেই ওই দফতরের দায়িত্ব পেয়েছেন অমিত মিত্র।
এলাকার মানুষের বক্তব্য, এলাকায় চোলাই মদ কুটির-শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিধানসভা ভোটের আগে কিছুটা ধরপাকড় বেড়েছিল। গত কয়েক মাসে ব্যবসা ফের বেড়েছে রমরমিয়ে। লেনিনগড়, বিলকান্দা, তালবান্দা, রতনের ঝিল-পাড়, শহরপুর, যোগেন্দ্রনগর ও কামালগাঁতি এই এলাকাগুলিই চোলাই উৎপাদনের ‘খাসতালুক’। বড় ভাটির সংখ্যা প্রায় শ’দুয়েক। এ ছাড়াও ঘরে ঘরে ছোট ভাটি। সব মিলিয়ে অন্তত ১৫ হাজার লোক চোলাইয়ের উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত বলে এলাকার মানুষই জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রতনের ঝিল-পাড় এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ঝিলের কুচকুচে কালো জল ঘিরে অসংখ্য ভাটি। দুর্গন্ধে টেঁকা দায়। চোলাই তৈরির কাঁচামাল এ পার থেকে ও পার আনা-নেওয়া চলছে ছোট ছোট ডিঙিতে। ভাটিকর্মীরা জানালেন, জল, চিটে গুড়, সোডার বাট আর মহুয়া ফলের পাঁচন দিয়ে তৈরি হয় ‘জাব।’ বড় হাঁড়িতে করে সেই জাব ঝিল-পাড়ের অল্প জলে পুঁতে রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পরে জাবে পচন ধরলে হাঁড়ি তুলে এনে উনুনে জ্বাল দেওয়া হয়। পাতন প্রক্রিয়ায় চোলাই তৈরি করে রাখা হয় বড় পাত্রে। |
এ তো গেল উৎপাদনের প্রক্রিয়া। এর পরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চোলাই ব্যবসায়ীরা ম্যাটাডরে জ্যারিকেন-ভর্তি চোলাই নিয়ে যান। নিউ ব্যারাকপুরের কারবারিদের নিজস্ব ‘নেটওয়ার্ক’ও কিছু কম নয়। সকাল থেকে শ’য়ে শ’য়ে লোকজন নেমে পড়ে সেই কাজে। সাইকেল, ভ্যান, ম্যাটাডরে চোলাইয়ের পাউচ, জ্যারিকেন পৌঁছে যায় হাওড়া বা শিয়ালদহ স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেনে তুলে দেওয়া হয় চোলাই। সড়ক পথেও জোগানের ব্যবস্থা আছে। চোলাই কারবারিদের মোবাইল নম্বর জানা থাকলে ‘হোম-ডেলিভারি’র ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সাইকেল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে ‘ক্যারিয়ার’। তাদের কাছেও মেলে চোলাইয়ের প্যাকেট। ঠেক অবধি যেতেও হয় না গ্রাহককে।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা আবগারি দফতর সূত্রের খবর, গোটা জেলায় দেশি মদের দোকান ৯০টির মতো। বিদেশি মদের দাম বাড়ার পরে দেশি মদের বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। এই পরিস্থিতিতে চোলাইয়ের জোগানের সঙ্গে দেশি মদ পাল্লা দিতে পারছে না।
পুলিশের একাংশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, চোলাইয়ের কারবারে যাঁদের টাকা খাটে, তাঁদের অন্য ব্যবসাও আছে। চোলাইয়ের ক্ষেত্রে প্রায় তিন গুণ মুনাফা। প্রায় শ’পাঁচেক ‘বড় মাথা’ এই ব্যবসায় নিয়মিত টাকা ঢেলে থাকেন। শহরপুর এলাকার এক ব্যবসায়ী জানালেন, তাঁর আসবাবপত্র-সহ অন্যান্য দোকানপাট আছে। এর পাশাপাশি এই এলাকায় তিনটি ভাটি লিজে নিয়ে চালাচ্ছেন। ভাটি মালিকদের অনেকেই এলাকার বাইরে থাকেন। ‘ভাটি-ম্যানেজার’-এর মাধ্যমেই লাভের অঙ্ক পৌঁছে যায় ‘বাবু’র ঘরে। মালিকেরা জানালেন, ব্যবসার খাতিরেই পুলিশ-প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হয় তাঁদের।
পুলিশ-প্রশাসনের হম্বিতম্বির সামনে কখনওই পড়তে হয় না মালিকদের। পুলিশি অভিযান হলে যাঁরা ধরা পড়েন, তারা নেহাতই দিনমজুর। সংগ্রামপুরে বিষ-মদে মৃত্যুর পরে যথারীতি পুলিশ-প্রশাসন, আবগারি দফতরের তৎপরতা বেড়েছে বুধবার থেকে। আবগারি দফতরের জেলা সুপারিন্টেনডেন্ট সমর স্বর্ণকার বলেন, “রাতে বেশ কিছু ধরপাকড়ও হয়েছে। ভাঙা হয়েছে বেশ কিছু ভাটি। প্রচুর মদ নষ্ট করা হয়েছে।” তার পরেও ব্যবসায় কমতি নেই। জেলার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা আবগারি দফতরের সঙ্গে মিলিত ভাবে অভিযান চালাচ্ছি। নজরদারির পাশাপাশি মানুষের সচেতনতাও দরকার।”
স্থানীয় এক চিকিৎসক জানান, কলুষিত পরিবেশে পুরুষ-মহিলা শ্রমিকেরা বছর পঁয়ত্রিশের বেশি কেউ কাজ করতেই পারেন না। তারপরে ক্যানসার, যক্ষ্মা, শ্বাসকষ্ট আরও নানা দুরারোগ্য রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। অনেকে অল্প বয়সে মারাও যান রোগে ভুগে। ১০-১২ বছরের ছেলেমেয়েদেরও এই কাজে লাগানো হয়। তাদেরও স্বাস্থ্য বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ভাটির বিষাক্ত ধোঁয়ায় আশেপাশের এলাকায় দূষণ ছড়ায়। লেনিনগড়ের চাঁদপুরে চোলাই তৈরির কারিগর ভবেন্দ্র সমাদ্দার বললেন, “দিনে ১৫০-২০০ টাকা পাই। তাতে সংসার চলে না।” সমীর রায় বলেন, “মদ তৈরি করে যা টাকা পাই, তাতে খুবই কম। সরকার বহু বার বিকল্প পেশার কথা বলেছে। কিন্তু কিছুই হয়নি।” |