চোলাই, জাল মদের রমরমা বাড়ছে পশ্চিমে
শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, পঞ্চায়েতের সদস্য থেকে শিক্ষককে নেই এই কারবারে! মোটা অঙ্কের মুনাফার লোভে খড়্গপুর লোকাল থানার বরগাই, নানকারে প্রায় কুটির শিল্পই হয়ে গিয়েছে চোলাই তৈরি। শুধু চোলাই-ই নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চলছে নকল মদেরও রমরমা কারবার। কম দামের টানে চোলাই-নকল মদের ভাটি কিংবা ঠেকে দিনে দিনে বাড়ছে মদ্যপের সংখ্যাও। চোলাই-নকলের এই রমরমায় এক দিকে যেমন সরকারি রাজস্বের ক্ষতি, তেমনই যে কোনও মুহূর্তে রয়েছে মৃত্যুরও হাতছানি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মগরাহাট, উস্তি, মন্দিরবাজারের মতো ঘটনার পরে রাজ্য জুড়েই এখন তোলপাড় হচ্ছে। চোলাই খেয়ে কোথাও এক সঙ্গে অনেক জনের মৃত্যুর পরে পরে এমন তোলপাড় আগেও হয়েছে। পুলিশ-আবগারি দফতরের সক্রিয়তা বেড়ে যায় আচমকাই। ভাটি কিংবা ঠেকে তল্লাশি চলে কয়েক দিন। তার পর আবার যে-কে-সেই। দিনে দিনে বেড়েই চলেছে বেআইনি মদের কারবার।
চোলাই-নকল মদের কারবার বেড়ে যাওয়ার পিছনে আবগারি দফতরের কর্মী ও আধিকারিকরা তিনটি কারণ নির্দিষ্ট করছেন। এক, মোটা অঙ্কের মুনাফার লোভে একদল লোক এই কারবার ফেঁদে বসেছে। দিন দিন বাড়িয়ে চলেছে কারবারের আয়তন। দুই, পুলিশ-আবগারি দফতরের এক শ্রেণির কর্মীর যোগসাজশে লোক দেখানো তল্লাশির পরেই সব থিতিয়ে যায়। পুলিশ-আবগারি কর্মীদের সঙ্গে মাসিক বন্দোবস্তের ভিত্তিতেই রমরমিয়ে চলতে থাকে অবৈধ কারবার। তিন, বৈধ দেশি-বিলিতি মদের দাম ক্রমেই বেড়ে চলায় গরিব, নিম্নবিত্ত নেশারুদের কাছে আকর্ষণ বাড়ছে সস্তার চোলাইয়ের। সেখানে পাত্তাই পায় না প্রাণহানির আশঙ্কা। এ সবের বাইরে অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মতো কারণ তো রয়েছেই।
আবগারি দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলায় দেশি মদ বিক্রির হার বেড়েছে সামান্যই। আবার কমে গিয়েছে বিলিতি মদ বিক্রির হার। গত অর্থবর্ষে নভেম্বর পর্যন্ত যেখানে দেশি মদ বিক্রি হয়েছিল ২৫ লক্ষ ৪৯ হাজার ২১৪ এলপিএল (লন্ডন প্রুফ লিটার), এ বার সেখানে বিক্রি হয়েছে ২৬ লক্ষ ০৮ হাজার ৫৭০ এলপিএল। মাত্র ২.৩২ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে। অন্য দিকে, পূর্ববর্তী সময়সীমায় গত বছর বিলিতি মদ বিক্রি হয়েছিল যেখানে ২৭ লক্ষ ৯৫ হাজার ৪৪৬ বাল্ক লিটার, এ বার তা হয়েছে ২৫ লক্ষ ৫৩ হাজার ৬৮০ বাল্ক লিটার। অর্থাৎ বিক্রির হার কমেছে ৮.৬৪ শতাংশ। গত বছর শুধু নভেম্বর মাসেই জেলায় বিলিতি মদ বিক্রি হয়েছিল ৪ লক্ষ ৫৯ হাজার ৮২৪ বাল্ক লিটার। এ বার নভেম্বরে বিক্রি মাত্র ২ লক্ষ ৬৩ হাজার ৩৩৮ বাল্ক লিটার! মাসের তুলনায় বিক্রির হার কমেছে ৪২.৭৩ শতাংশ!
আবগারি দফতরের বক্তব্য, দেশি মদের বিক্রি সামান্য বাড়ছে, বিলিতি মদের বিক্রি পড়ে যাচ্ছে মানে লোক কম নেশা করছে--তা কিন্তু নয়। বরং চোলাই কিংবা নকল মদ খাওয়া বাড়ছে বলেই কমছে সরকারি ভাবে অনুমোদিত মদের বিক্রি। অথচ সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ‘বার’ বা দোকানের সংখ্যা কিন্তু বাড়ছে। তার পরেও কমছে দেশি-বিলিতি মদের বিক্রি। এই মুহূর্তে জেলায় দেশি মদের ‘বৈধ’ দোকান রয়েছে ১১৮টি। স্থায়ী ও অস্থায়ী বারের সংখ্যা ১১৫টি। বিলিতি মদের দোকান রয়েছে ৬৭টি। কিন্তু এ সব দোকান-বারের চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে চোলাই-ঠেকের সংখ্যা। সেখানে বিক্রিবাটাও ঊর্ধ্বমুখী।
আবগারি সূত্রের ব্যাখ্যা, গত বছর অক্টোবরেই সরকার দেশি মদের দাম প্রায় দ্বিগুণ করে দেয়। ২৩ টাকার মদের দাম বেড়ে হয় ৪৪ টাকা। নতুন রাজ্য সরকারও বিলিতি মদের দাম বাড়িয়েছে। ফলে কিছু লোক বিলিতি ছেড়ে দেশি মদ ধরেছে। আর বেশির ভাগই দেশি ছেড়ে শরণ নিয়েছে চোলাইয়ের। ৪৪ টাকায় যে পরিমাণ দেশি মদ মেলে, সেই পরিমাণ চোলাইয়ের দাম ঘোরাফেরা করে ১২ থেকে ১৬ টাকার মধ্যে (কখনও গুড়ের দাম বাড়লে বড়জোর ২০টাকা)। দামের এই আসমান-জমিন ফারাকই সস্তার চোলাইয়ের দিকে লোকজনকে ঠেলে দিচ্ছে বলে আবগারি সূত্রের বক্তব্য।
চোলাইয়ের থেকেও ‘বিষময়’ নকল মদ। দামি সংস্থার পুরনো বোতলে অপটু হাতে তৈরি নকল মদ ভরে চলে এই কারবার। পুরনো বোতলে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকেই। অপটু হাতে তৈরি হওয়ায় স্পিরিটের সঙ্গে অন্য দ্রব্যের মিশ্রণের সামঞ্জস্যও থাকে না। নকল মদ সহজেই হয়ে ওঠে তরল বিষ।
কিন্তু কেন নিয়মিত তল্লাশি হয় না? আবগারি দফতরের অবশ্য দাবি, তল্লাশি হয়। পরিসংখ্যান দিয়ে তারা জানাচ্ছে, গত অর্থবর্ষে নভেম্বর পর্যন্ত ২৩৩৪টি জায়গায় তল্লাশি করে মামলা রুজু করা হয়েছিল। গ্রেফতার করা হয়েছিল ৬৭ জনকে। আর এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত রুজু করা হয়েছে ২১২০টি মামলা। ১২৩ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু আবগারি দফতরই জানাচ্ছে, পর্যাপ্ত কর্মী এবং পরিকাঠামো না থাকায় নিয়মিত তল্লাশি চালানোয় সমস্যাও রয়েছে। জেলা আবগারি দফতরে অনুমোদিত অফিসারের পদ ৮১টি। রয়েছেন মাত্র ৪০ জন। সব সময়ে পুলিশি সহযোগিতাও পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ আবগারি অফিসারদের। মগরাহাট-উস্তি কাণ্ডে শতাধিক মৃত্যুর পর অবশ্য তল্লাশি জোরদার করার কথা বলছেন জেলা আবগারি সুপারিনটেনডেন্ট পরিমলকান্তি দত্ত। শাসকদলের নেতা, মেদিনীপুরের বিধায়ক মৃগেন মাইতি আবার চোলাইয়ের বিরুদ্ধে ‘সচেতনতা কর্মসূচি’র কথাও বলছেন।
সময়ই বলবে চোলাইয়ের চল কমল না বাড়ল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.