আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাম বিতর্ক’ মেটাতে কমিটি মমতার |
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে ‘মাদ্রাসা’ যুক্ত করা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনেই সরকারি অনুষ্ঠানে কাজিয়ায় জড়িয়ে পড়ল দুই গোষ্ঠী। রাজারহাটের ওই অনুষ্ঠানে শেষপর্যন্ত ‘উত্তপ্ত’ পরিস্থিতি সামাল দিতে হল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকেই। বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে চার সদস্যের এক কমিটি গঠনের কথা অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকেই ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
বৃহস্পতিবার রাজারহাটে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ তলা ভবন এবং ১০ তলা ‘হজ ভবনে’র শিলান্যাস ও নিউটাউনে শিশুদের উদ্যান ‘শিশুতীর্থে’র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠান ছিল। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে ‘মাদ্রাসা’ শব্দটি যুক্ত করা নিয়ে ফরফুরা শরিফের পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি তাঁর বক্তৃতায় দাবি তুলতেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই গোষ্ঠীর বিবাদ বাধে। হৈ-হল্লা শুরু হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী সকলকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়ে বলেন, “নাম নিয়ে এখানে আলোচনা করতে আসিনি। আপনারা দয়া
করে বসুন।’’
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার ওই অনুষ্ঠান হওয়ার কথা থাকলেও আমরি-কান্ডে সে দিন মুখ্যমন্ত্রী তা বাতিল করেছিলেন। এ দিন সেই কথা স্মরণ করিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এই অনুষ্ঠান সংখ্যালঘু ভাইবোনেদের কাছে বড় দিশা দেখাবে।” দুই গোষ্ঠীর বিবাদে ‘বিরক্ত’ মুখ্যমন্ত্রী ত্বহাকে সরাসরিই বলেন, “তহ্বা সাহেব, এখানে এসব করার কী দরকার!” কিন্তু তখনও অনুষ্ঠান-মণ্ডপে দু’পক্ষের বাদানুবাদ চলছিল। বাধ্য হয়েই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বাংলায় অনেক রাজনীতি হয়েছে। ঝগড়াঝাটি বন্ধ করুন। ঝগড়া করলে আপনারাই পিছিয়ে পড়বেন।” মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “কিছু বলার থাকলে চিঠি লিখে আমার বাড়ির পাশে অফিসে দিয়ে আসবেন। সকাল ১০ টার সময় অফিসটা খুলে যায়। কিন্তু মিটিংটা পন্ড করবেন না।” |
বাম সরকারের আমলেই আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে ‘মাদ্রাসা’ যুক্ত করার দাবিতে এক বছর আগে মাদ্রাসা ইউনিয়নের ছাত্ররা অনশন-আন্দোলন করেছিলেন। তখন তাঁদের অনশন ভাঙিয়ে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা সরকারে এলে ছাত্রদের ওই দাবি পূরণ করা হবে। এ দিন শিলান্যাস অনুষ্ঠান শুরুর আগে ‘পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়নে’র রাজ্য কমিটির তরফে একটি বিবৃতি বিলি করা হয়। সেই বিবৃতিতে কার্যত ‘কটাক্ষই’ করা হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে ‘মাদ্রাসা’ শব্দ যুক্ত করা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিকে ‘ফাঁকা আওয়াজ’ বলেও মন্তব্য করা হয়। যা জেনে মমতা পাল্টা বলেন, ‘‘ইনসা আল্লাহ্, মমতা ব্যানার্জি আপনাদের প্রতারিত করবে না। আল্লার দোয়ায়, আপনাদের আর্শীবাদে আমরা ক্ষমতায় এসেছি। তাই নিজেকেও কুরবানি দিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করব না।”
ত্বহার একটি কথায় অনুষ্ঠান উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, “বামফ্রন্ট সরকার মাদ্রাসা নামটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ করেনি। আমরা তখন বলেছিলাম বামফ্রন্ট সরকার মাদ্রাসা নাম যোগ না করলে এদের আমরা মুছে দেব। সেটা মুছে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি!’’ এরপরেই তিনি ‘মাদ্রাসা’ যুক্ত করার দাবি তুললে শ্রোতাদের মধ্যে থেকে সরবে আপত্তি ওঠে। দাবি, পাল্টা দাবি নিয়ে হল্লা শুরু হয়। যাতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়, রাজ্যের মন্ত্রী আবদুল করিম চৌধুরী, পূর্ণেন্দু বসু, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, ফিরহাদ হাকিম, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দুই তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার, হাজি নুরুল ইসলাম প্রমুখকে কিছুটা ‘অপ্রস্তুত’ই দেখায়।
পরিস্থিতি সামলাতে হাল ধরেন স্বয়ং মমতা। তিনি বলেন, “আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এম’ থাকবে। আমরা সংশোধন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে দেব।” মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, “এম মানে মাদ্রাসা হতে পারে। মুসলিম হতে পারে। মমতাজও হতে পারে। আলিয়া মাদ্রাসা নামে দরকারে আরও একটা বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। এটা নিয়ে দু’টো মতামত করে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবেন না।’’
পরিস্থিতি ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। মাদ্রাসা নিয়ে মুসলিমদের এক অংশের যেমন ধর্মীয় আবেগ রয়েছে, তেমনই সর্বভারতীয় চাকরির প্রতিযোগিতায় মাদ্রাসার বদলে বিশ্ববিদ্যালয় নামের প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনাই মর্যাদা পাবে বলে অন্য অংশ মনে করছেন। তা অনুধাবন করেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের আগের সরকার করে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখানেই এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। হাজি নুরুল, মন্ত্রী হায়দার আজিজ সফি, ত্বহা এবং টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বরকতি সাহেবকে নিয়ে একটি কমিটি করে দিচ্ছি। তারাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।’’ কমিটির সিদ্ধান্ত জেনে সংশোধনী সহ নতুন করে বিধানসভায় একটি বিল আনতে হবে বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানান। ‘সংখ্যালঘু উন্নয়নে’ তাঁর সরকার কী কী করছে তা-ও সবিস্তারে বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
অনুষ্ঠান সেরেই মমতা দিল্লি রওনা হন। তাঁর ফেরার কথা শনিবার বিকালে। দিল্লি যাওয়ার আগে রাজারহাটে নির্মীয়মান ‘ইকো পার্ক’ পরিদর্শন করেন মুখ্যমন্ত্রী। |