অনন্ত মাতালে সার সার কড়াইতে ফুটছে চোলাই।
জায়গাটি ইস্টার্ন বাইপাসে সায়েন্স সিটির অদূরে। পরমা আইল্যান্ড থেকে উত্তরে যেতে বড় রাস্তার ডান দিকে সে এক অন্য জগৎ। ওই এলাকারই নাম ‘অনন্ত মাতাল’।
ধাপার জঞ্জালের পাহাড়ের নীচে সেখানে চোলাইয়ের ভাটিতে আগুন জ্বেলে দিনে-দুপুরে টগবগিয়ে ফোটে ঝাঁঝালো তরল। স্থানীয় লোকে বলেন, “পুরসভার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডে মাছের ভেড়ির কাছে ওই তল্লাটে পৌঁছলে ঝাঁঝালো গন্ধে নাকে রুমাল চাপতে হবে।” মেগাসিটি কলকাতা ছাড়িয়ে দূরে যাওয়ার দরকার নেই। শহরের পুর-এলাকাতেই জমজমাট চোলাই-শিল্পের ‘আঁতুড়ঘর’।
রাতের সল্টলেকে শুল্ক দফতরের আবাসন লাগোয়া ঝুপড়ির পাশেও ঝাঁঝালো গন্ধটা টের পান লাগোয়া ব্লকের বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, ১২ নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে দিনের সফর শেষ করার আগে বাসচালক-খালাসিদের ওটাই ‘লাস্ট স্টপ’। কোনও কোনও দিন ২০-২৫ মিনিট ধরে বাসটি কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। ঝুপড়ির পাশের ঠেক থেকে ‘পাউচ’ এনে জমে ওঠে বাসকর্মীদের রাতের মৌতাত। ভিআইপি রোডের ধারে গোলাঘাটা, কেষ্টপুর খাল লাগোয়া এলাকা বা ভাঙড়ের ভেড়ির চোলাই-ভাটি থেকে নিয়মিত জোগানে বছরভর যথেষ্টই ‘সমৃদ্ধ’ সল্টলেকের ওই চোলাই-ঠেক।
এ সব কোনও বিচ্ছিন্ন দৃশ্য নয়। মগরাহাটের বিষমদ-কাণ্ডে প্রায় ১৫০ জনের মৃত্যুর পরেও খাস কলকাতা বা লাগোয়া এলাকায় ভালই চলছে চোলাইয়ের চোরাগোপ্তা কারবার। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিমের অবশ্য দাবি, “দু’বছর আগে বন্দর এলাকায় বিষমদে ১৪ জনের মৃত্যুর পর থেকেই চোলাইয়ের বিষয়টিতে আমরা একটুও আপস করি না। নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। থানায় থানায় কড়া নজরদারি বহাল। দু’মাস আগে সংযুক্ত এলাকাতেও অভিযান চালানোর পরে চোলাইয়ের উৎপাত বন্ধ।”
বলাই সার। স্থানীয় পুলিশ-আধিকারিকেরাও ঠারেঠোরে জানিয়ে দেন, বন্দর লাগোয়া ওয়াটগঞ্জ থানার যৌনপল্লির কাছাকাছি চোলাই কারবার এখনও জমজমাট। যেমন পুরোপুরি বন্ধ হয়নি কলকাতার চিরাচরিত চোলাই-ঠেকগুলিও।
উত্তর কলকাতায় বেলগাছিয়ার ওলাইচণ্ডীতলা-নতুনপাড়ার ‘নেপালি’ বস্তিতে চোলাই এখনও ‘কুটির-শিল্প’। ঘরে ঘরে অতি সন্তর্পণে চোলাই তৈরি করে হতদরিদ্র এক-একটি পরিবার। চিৎপুরে রিজেন্ট সিনেমার উল্টো দিকের গলি, টালা সেতুর নীচে ঘোষবাগান বস্তি বা বাগবাজারের চামারপট্টির চোলাই-ঠেক পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। শামিমও বলেন, “চোলাই বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে, এমনটা বলা যায় না। তবে রেললাইন ধরে মাঝেমধ্যে ও সব শহরে ঢোকে। রেলপুলিশের সঙ্গে মিলে মাঝেমধ্যে অভিযান চলে।”
তবে পুলিশকর্মীদের একাংশ মানছেন, শহরে চোলাই পাচারের আরও কিছু ‘সহজ পথ’ খুঁজে নিয়েছে কারবারিরা। কী ভাবে?
পুলিশ সূত্রের খবর, মাঝেমধ্যে ঝকঝকে ছোট গাড়িতেও সামনে বসে থাকে কেতাদুরস্ত কোনও ব্যক্তি। পিছনে ঠাসা চোলাইয়ের পাউচ, জেরিক্যান বা তরল ভরা ফুটবলের ব্লাডার। হুগলির বেগমপুর থেকে বালি হয়ে ওই ভাবেও চোলাই ঢুকে পড়ে কলকাতায়। স্থানীয় পরিভাষায় এর ডাকনাম, কালো রঙের একটি চেনা নরম পানীয়ের নামে। স্থানীয় পুলিশ জানাচ্ছে, নাগেরবাজার এলাকায় পাঁচ টাকার পাউচের নাম হল ‘পাঁক’।
পুলিশ অবশ্য সর্বত্রই চোলাই ঠেকাতে ‘তৎপরতা’র দাবি করছে। শামিমের কথায়, “ট্যাংরা, হরিদেবপুর, পূর্ব যাদবপুর, ঠাকুরপুকুর, বাঁশদ্রোণী, নোনাডাঙার মতো ঠেকগুলি ভাঙতে পুলিশি অভিযান সফল হয়েছে। ৪০ জন গ্রেফতার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ৫৭৫৬ লিটার মদ।” হাওড়ার গোয়েন্দাপ্রধান অখিলেশ চতুর্বেদীও বলছেন, “গত তিন মাসে ১০৪টি ঠেক ভাঙা হয়েছে। পাঁচ হাজার লিটার মদ উদ্ধার হয়েছে। গোলাবাড়ি, মালিপাঁচঘরার ঠেকগুলি এখন বন্ধ।” উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্যের দাবি, “মগরাহাটের ঘটনার পরে জেলায় প্রচুর ঠেক ভাঙা হয়েছে। পুলিশ নিয়মিত চোলাইয়ের ঠেক ভাঙার অভিযান চালাচ্ছে।”
বাস্তবের ছবিটি অবশ্য অন্য রকম। দত্তাবাদের ভাঁড়পট্টি, ফুলবাগানের কাছে বাইপাসের উপরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের উল্টো দিকে এখনও চোলাই ব্যবসার রমরমা। বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দত্তাবাদেই বিষমদ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল বলে অভিযোগ। শিল্পতালুক পাঁচ নম্বর সেক্টরে টেকনোপলিসের কাছে, নয়াপট্টির চকমন্দির, নতুন বাজার এলাকা, মহিষবাথান, পোলেনআইট-সহ সংযুক্ত এলাকার অনেক জায়গাতে এখনও চোলাইয়ের আসর বসে।
রাজারহাট-নিউটাউনে ‘ঢাকঢাক গুড়গুড়টি’ও নেই। জামালপাড়া, থাকদাঁড়ি, হাটগাছা, চাঁদপুর এলাকায় বাড়ির ভিতরে চোলাইয়ের ঠেক চলে। ঘরে ঢুকে পুলিশ অভিযান চালায় না। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি সেই চোলাই সাইকেলে চাপিয়ে বিক্রি করতে যান কারবারিরা। কখনও জলের ড্রাম, কখনও মাছের হাঁড়ির ‘প্যাকিং’-এও পুলিশের নজর এড়িয়ে শহরে ঢুকে পড়ে চোলাই। মগরাহাটের মতো ঘটনার পরে এর পসার সামান্য থিতিয়ে গেলেও, তা ফের জাঁকিয়ে বসে কিছু দিনেই। |