জারের দেশে
‘মিশরের ঝড়ের’ মুখে
স্বপ্ন-দেখানো পুতিনও
ত্তাল, অশান্ত। হাড় কাঁপানো শীত। বরফ পড়ছে। তা উপেক্ষা করে শুধু মস্কো নয়, রাশিয়ার প্রায় ষাটটি শহরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে পুতিন-বিরোধী বিক্ষোভ।
বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আসার পথে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-ও কি এ সব দেখতে দেখতে ভাবছেন যন্তর-মন্তরে অণ্ণা হজারের আন্দোলনের ভূত আজ জারের সাম্রাজ্যেও এসে আছড়ে পড়ছে? ক্রেমলিনের প্রাসাদের সামনে মস্কোভা নদী। সুউচ্চ ওয়াটার টাওয়ার এক দিকে। অন্য দিকে ক্রেমলিন ক্যাথিড্রাল। বোট-এ এক ঝাঁক বিক্ষোভকারী তরুণ-তরুণী। হাতে পোস্টার-ব্যানার। মুখে স্লোগানআমরা চাই পুতিনহীন রাশিয়া। ক’দিন আগে ফ্রান্সের কান শহরে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখেছেন মনমোহন। ওয়াল স্ট্রিট দখলের আন্দোলনও উথালপাথাল করেছে তামাম দুনিয়ার মানুষকে। পশ্চিমি কিছু ভাষ্যকার প্রশ্ন তুলেছিলেন, এ হেন রাশিয়ায় মনমোহন সিংহের আসা কি উচিত হচ্ছে? বিদেশ মন্ত্রক মনে করেছে, আলবাৎ উচিত হচ্ছে। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, বিদ্রোহ-বিক্ষোভ দেখে ভারত দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে না। ভ্লাদিমির পুতিন যত দিন প্রধানমন্ত্রী আছেন তত দিন তাঁর সঙ্গেই মনমোহনের বোঝাপড়া।
পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। পুঁজিবাদের সংকট, আর্থিক মন্দার ঝড় মার্কিন মুলুক থেকে ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারত-চিন সর্বত্রই। প্রায় প্রতিটি দেশেই আজ রাষ্ট্রনেতারাও প্রবল বিদ্রোহের মুখে। গ্রিস, ইতালির রাষ্ট্রনায়কদের পরিবর্তন সদ্য দুনিয়া দেখেছে। বারাক ওবামার নির্বাচন আগামী বছর। ওবামাও ঝড়ের মুখে। পুতিন ৪ ডিসেম্বরের ভোটে জিতে এসেছেন বটে কিন্তু শাসক দল ইউনাইটেড রাশিয়া চার বছর আগের নির্বাচনের তুলনায় শতকরা ১৫ শতাংশ ভোট হারিয়েছে। স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আসলে না কী পুতিন হেরেই গিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদা যে ভাবে কমিউনিস্টদের সম্পর্কে অভিযোগ তুলেছিলেন বৈজ্ঞানিক রিগিং-এর, ঠিক সে ভাবে আজ রাশিয়ার মানুষ আঙুল তুলেছে প্রাক্তন কেজিবি কর্তা পুতিনের দিকে। অভিযোগ, অবাধ নির্বাচন হয়নি। ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ভিডিও ফুটেজ ইন্টারনেটে ঘুরছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
তিউনিশিয়া আর মিশরের মতো রাশিয়াতেও এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে কিন্তু মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ। ভরসা ফেসবুক, ট্যুইটার। রাশিয়ায় পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ ফেসবুক-টুইটারে সক্রিয়। যা ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে সব থেকে বেশি। স্থানীয় সাংবাদিক ভ্লাদিমির র্যাডিউহিন বলেন, “মস্কোর টেলিভিশন আজও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। তারা ভোট নিয়ে বিতর্ক-বিক্ষোভ কিছুই দেখাচ্ছে না। তাই এখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কই ভরসা।” এ শহরে এসে দেখছি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব কিন্তু বেকার যুবকরা অথবা ‘লুম্পেন’ সমাজ দিচ্ছে না। বরং অর্থবান, শিক্ষিত, পেশাদার নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা অনেক বেশি এগিয়ে এসেছেন।
চিনের তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে ১৯৮৯ সালে গুলি চলেছিল। আবার ’৯৩ সালে সশস্ত্র কমিউনিস্ট বিদ্রোহ থামাতে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিন ট্যাঙ্ক পাঠিয়েছিলেন। শ’য়ে শ’য়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এ বার কমিউনিস্টরাও আগের থেকে তুলনায় অনেক ভোট পেয়ে রাশিয়ান ডুমা’য় প্রবেশ করেছেন। তাঁদের সাহায্য ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করাতে পারবেন না পুতিন। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরা বলছেন, ওই কমিউনিস্টরা, বামপন্থী ‘জাস্ট রাশিয়া’, ভ্লাদিমির ঝিরিনোভস্কির উদার গণতন্ত্রী দলও ক্রেমলিন নামক প্রতিষ্ঠানের
অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আর ক্রেমলিন প্রাসাদের সামনে আজ যারা মিছিল করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু মূলত কোনও দলের প্রতিনিধি নন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অতি-বামরা আছেন ঠিকই। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে এই পথে নামা তরুণ-তরুণীরা সমাজের অসন্তোষের মূর্ত প্রতীক মাত্র। এবং তাঁরা কিন্তু হিংসার পথ ধরে হাঁটছেন না। তাঁরা মস্কোর পুলিশের উদ্দেশে ফুল ছুঁড়তে ছুঁড়তে চলেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রথম ভোটার। মনমোহনের সফরের ঠিক আগে বহু বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতারও করেছে পুতিনের পুলিশ। পশ্চিমের মদতে রাশিয়াকে দুর্বল করার চক্রান্তও তিনি দেখছেন এই বিক্ষোভের মধ্যে। বলছেন, বরাবরই ক্ষমতার দখল পেতে বিরোধীরা সরকারপক্ষকে টেনে নামানোর চেষ্টা করে। সেই সঙ্গে আবার অন্য চালও চালছেন। আজ তিনি বললেন, “দেখে ভাল লাগছে, এত তরুণ রাস্তায় নেমেছে। এই বিক্ষোভ দেখাতে পারার পরিবেশ যদি পুতিন-জমানার ফল হয়, মন্দ কী?”
দীর্ঘ দিনের জারতন্ত্রকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র রাশিয়ায় কায়েম ছিল দীর্ঘ সাত-আট দশক। কিন্তু গরবাচভের পেরেস্ত্রোইকার পর যখন দ্রুত সোভিয়েত সমাজ বদলাতে লাগল, সেন্ট পিটার্সবার্গের পুতিন কিন্তু তখন ঘোষণা করেছিলেন তিনি ফিরিয়ে আনবেন সেই পুরনো শক্তিশালী সোভিয়েত রাষ্ট্রকে। জারদের হত্যা করেছিলেন একদা কমিউনিস্টরা। আর আজ রাশিয়ার সাধারণ মানুষ জারদের সেই সব প্রাসাদ দেখতে গিয়ে চোখের জল ফেলেন। পুতিন আজ যেন আবার সেই জারতন্ত্রের ঐতিহ্য বহন করে গড়ে তুলতে চান শক্তিশালী রাশিয়াকে। বলকানাইজেশন বা সাবেক সোভিয়েত টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার দুঃখ ঘোচাতে মরিয়া তিনি।
কিন্তু দুর্নীতি, মাফিয়াতন্ত্র, বেকারত্ব এ সব থেকে রাশিয়ার মানুষকে কী করে মুক্ত করবেন পুতিন? অভিযোগ, দুর্নীতির ব্যাপারে বিশেষ কিছুই করেননি তিনি। উল্টে যে ভাবে তাঁর বশংবদ শিষ্য মেদভেদেভকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং আগামী বছর ফের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, তাতে মানুষ আরও ক্ষিপ্ত। মেদভেদেভকে লোকে বলে ‘ট্যুইটার প্রেসিডেন্ট’। ছেলেমানুষের মতো সারা দিন ধরে ইলেকট্রনিক গ্যাজেট নিয়ে ‘খেলা করতেই’ ব্যস্ত থাকেন তিনি। এমনটাই মস্কোর কড়চা। কিন্তু পুতিনকে তো মানুষ মনে করছেন ষড়যন্ত্রী।
এই চক্রব্যূহ থেকে তা হলে কী করে বেরোবেন ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন ?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.