খোলামুখ কয়লা খনির জন্য মাটি ফেলে নদীর গতি আটকে রাস্তা তৈরির অভিযোগ উঠল ‘পাবলিক-প্রাইভেট পাটর্নারশিপ’-এ (পিপিপি) গড়া সংস্থার বিরুদ্ধে। বীরভূমের দুবরাজপুরের লোবা অঞ্চলে হিংলো নদীর উপরে ওই রাস্তা বানানোয় অভিযুক্ত সংস্থাটি হল ‘ডিভিসি-এমটা কোল মাইনস লিমিটেড’। তাদের ওই রাস্তা নিয়ে এলাকায় অসন্তোষ দানা বাঁধছে। নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে তৈরি ওই রাস্তা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি, চিন্তিত নদী-বিশেষজ্ঞেরাও। সোমবারই এলাকা ঘুরে নদীর গতিপথ ‘মুক্ত’ করার জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন জানান পরিবেশ-কর্মী সুভাষ দত্ত।
দুবরাজপুরের লোবা পঞ্চায়েতের লোবা-সহ ১০টি মৌজায় প্রায় ৩,৫০০ একর জমিতে ওই খোলামুখ কয়লা খনি গড়ে ওঠার কথা। সে জন্য জমি কেনা শুরু করেছে ‘ডিভিসি-এমটা’। দু’-একটি মৌজা থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে অল্প কিছু জমি কিনে খননের কাজও শুরু করেছে তারা। দিন পনেরো আগে ওই সংস্থার তরফে পলাশডাঙা গ্রাম এবং পলাশডাঙা চরের মধ্যে হিংলো নদীর উপরে রাস্তা বানানোর জন্য মাটি ফেলতে দেখেন এলাকাবাসী। দেখতে দেখতে প্রায় ১৫০ মিটার দীর্ঘ এবং ফুট চারেক উঁচু রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। কাজ বাকি সামান্যই। স্থানীয় কৃষিজীবী ফেলারাম মণ্ডল, দীপক ঘোষদের বক্তব্য, “আমাদের এলাকায় পর পর দু’টো নদ-নদী। হিংলো আর অজয়। সে জন্য এখানকার মাটি খুব ভাল। বছরে দু’বার ধান আর শীতে সব্জি চাষ হয় হিংলোর ধার বরাবর অনেকটা এলাকা জুড়ে।” তাঁদের উদ্বেগ, “পলি-বালি জমে এখন হিংলো বড়জোর একমানুষ গভীর। এই অবস্থায় নদীটার মাঝ বরাবর রাস্তা হয়ে গেলে বর্ষাকালে জল উপচে দু’পাড় ভাসিয়ে দেবে। মাটির সঙ্গে বালি এসে যদি খেতে জমে যায়, চাষ করব কী ভাবে?” |
দুবরাজপুরে হিংলো নদীর উপর তৈরি হচ্ছে রাস্তা। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত। |
গতিপথ আটকে রাস্তা তৈরি করা হলে হিংলো নদী যে কোনও সময় বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তা মনে করিয়ে দিয়ে নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, “হিংলো বন্যা-প্রবণ নদী। ওই আপাত নিরীহ নদী ১৯৭৮ সালের বন্যায় ভয়ানক কাণ্ড ঘটিয়েছিল। খয়রাশোলে হিংলো নদীতে একটা জলাধার আছে। সেখান থেকেও যখন জল ছাড়া হবে, তখন নদীর বুকে এই রাস্তা জলের গতি আটকে প্লাবন ঘটাবে। ওই রাস্তা নদীর গতি-ভারসাম্যকে ধ্বংস করবে।” ঘটনাস্থল ও লাগোয়া এলাকা ঘুরে দেখে এ দিন ক্ষোভ প্রকাশ করেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তিনি বলেন, “যে ভাবে এখানে মাটি ফেলে নদীর গতিপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেটা অন্যায়। এতে বন্যা-পরিস্থিতির আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, তেমনই জীব-বৈচিত্র বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এই রাস্তাটার জন্য হিংলোর গতিপথে সামনের দিকের গ্রামগুলিতে ঠিকমতো জল পৌঁছবে না।” নদীর গতি ‘মুক্ত’ করতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) কৃষ্ণা মাড্ডির কাছে আবেদন জানান। অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) বলেন, “পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” খোলামুখ খনি নির্মাণকারী ‘ডিভিসি-এমটা’র জয়দেব-খাগড়া প্রকল্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্মল সরকার দাবি করেন, “গ্রামবাসীরা চেয়েছেন বলেই ওখানে রাস্তার জন্য মাটি ফেলছি। না হলে নদীতে রাস্তা বানানো আমাদের কাজ নয়। বন্যার সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে একটি প্রকল্প নিয়েছি। সে সংক্রান্ত মাস্টার-প্ল্যান সেচ দফতরের কাছে পাঠানো হয়েছে। তা অনুমোদন হলে সেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে।”
যদিও স্থানীয় ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র নেতা জয়দীপ মজুমদারের পাল্টা দাবি, “খনি তৈরি করার জন্য যে জমি ওই সংস্থা কিনেছে, সেখান থেকে প্রচুর মাটি তুলতে হবে। মাটি তোলা শুরু হয়েছে। সেই মাটি অন্যত্র সরানোর জন্যই নদীতে রাস্তা গড়েছে ওই সংস্থা। অন্য রাস্তা দিয়ে মাটি নিয়ে যেতে খরচ অনেক বেড়ে যাবে বলেই ওরা নদীর গতি রোধ করছে।” |