জোট-শরিক এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আরও ‘সংঘাত’ এড়াতে প্রদেশ কংগ্রেসে তাঁর ‘ক্লাস’ স্থগিত রাখলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়।
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির কার্যকারিতা বোঝাতে আগামী রবিবার প্রদেশ কংগ্রেস দফতর বিধান ভবনে এ রাজ্যের দলীয় সাংসদ, বিধায়কদের ‘ক্লাস’ নেওয়ার কথা ছিল প্রণববাবুর। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য সোমবার দিল্লি থেকে ফিরে বলেন, “ওই বৈঠক এখন হবে না বলে প্রণবদা জানিয়েছেন। কবে হবে, তা পরে জানাবেন।” খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিকে অনুমোদন দেওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে তাঁর আপত্তিতে ‘অনড়’ থেকে মনমোহন সিংহ সরকারকে আপাতত ‘পিছু হঠতে’ বাধ্য করেছেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এই পরিস্থিতিতে খুচরোয় বিদেশি বিনিয়োগের সমর্থনে এই রাজ্যেই প্রচারে নামলে জোটে টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে, এই আশঙ্কাতেই প্রণববাবু কর্মসূচি স্থগিত রাখলেন বলে কংগ্রেসের একাংশের ব্যাখ্যা।
প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের পরিকল্পনা ছিল, খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকে সমর্থন জানিয়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারে নামা হোক। প্রণববাবুর সঙ্গে আলোচনা করেই প্রদেশ নেতারা ঠিক করেছিলেন, প্রচারে নামার আগে বিদেশি লগ্নি নিয়ে দলীয় নেতৃত্ব, বিশেষ করে দলের সাংসদ, বিধায়কদের বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা হবে। সেই লক্ষ্যে ঠিক হয়েছিল, রবিবার বিধান ভবনে প্রণববাবু নিজে সাংসদ, বিধায়কদের ‘ক্লাস’ নেবেন। কিন্তু ‘শিক্ষক’ প্রণববাবু নিজেই ‘ক্লাস’ স্থগিত রাখার প্রস্তাব দেওয়ায় কংগ্রেসের অন্দরে নানা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।
তার মধ্যে সর্বাধিক চর্চিত ব্যাখ্যাটি হল, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে ইউপিএ-র গুরুত্বপূর্ণ শরিক নেত্রী মমতা। ইতিমধ্যেই তাঁর সঙ্গে প্রণববাবুর বারকয়েক কথা হয়েছে। ফোনে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও। কিন্তু ‘চিড়ে না-ভেজায়’ মনমোহন তাঁর সঙ্গে আবার কথা বলবেন। দলীয় নেতাদের একাংশের অভিমত, এই ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’তে খুচরোয় বিদেশি লগ্নি নিয়ে দলীয় স্তরে কোনও পদক্ষেপ করার ঝুঁকি প্রণববাবুরা নিতে চান না বলেই বৈঠক স্থগিত রাখা হয়েছে। দলের অন্য অংশের মতে, মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের কথা হয়েছে। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে আরও সময় নিতে চান। তা ছাড়া, দলের ভিতরেও খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে নানা মত রয়েছে। সমস্ত বিষয়টি ‘সামাল’ দেওয়াই এখন ‘প্রথম কাজ’ বলেই প্রণববাবু প্রদেশের বৈঠক স্থগিত রাখতে বলেছেন।
এমতাবস্থায় ‘শর্তসাপেক্ষে’ খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে বলে সওয়াল করেছেন পিডিএসের রাজ্য সভাপতি সৈফুদ্দিন চৌধুরী। দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই যখন খুচরো ব্যবসার দ্বার বিদেশি বিনিয়োগের কাছে খুলে দেওয়ার বিরোধিতায় সরব, এমনকী কংগ্রেসকেও সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত রাখার কথা ভাবতে হচ্ছে, সেই সময় প্রাক্তন সাংসদ সৈফুদ্দিন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। খুচরো-বিতর্কে যে ভাবে সংসদ বন্ধ থাকছে, তাকে ‘সদর্থক আলোচনা ছাড়া শুধুই অচলের সাধনা’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
তাঁর দল পিডিএসের মুখপত্রের জন্য একটি নিবন্ধে সৈফুদ্দিন লিখেছেন, ‘খুচরো বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর খুঁটিনাটি, ভাল-মন্দ বিস্তৃত ভাবে জানা দরকার। তার পরেই একটি সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব। শুধু আবেগের বশে কিংবা রাজনৈতিক প্রয়োজনমাফিক এই বিষয়ে বা কোনও বিষয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না’। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, কৃষি ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও দোকানদার গোষ্ঠী, সাধারণ ক্রেতার স্বার্থের পাশাপাশিই দেশের কর ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার বিষয়টি খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িত। পরিকাঠামো গড়ে তোলার সম্ভাবনাও এর ফলে বাড়বে। অসংগঠিত খুচরো ক্ষেত্র থেকে সরকারের যে হেতু কর ওঠে না, তাই বিদেশি বিনিয়োগ অর্থনীতির হাল ফেরাতে অন্যতম দাওয়াই হতে পারে।
তবে বিদেশি বিনিয়োগ এলেও সরকারের ‘দায়িত্ব বিরাট’ বলে উল্লেখ করেছেন সৈফুদ্দিন। বড় শহরের বাইরে বিদেশি সংস্থাগুলিকে যেতে না-দেওয়া, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের থেকে সামগ্রী কেনা, বিনিয়োগের ৫১% পরিকাঠামো খাতে ব্যয়, অন্তত ৫০ ভাগ স্থানীয় সংগ্রহ এই রকম শর্তগুলি থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, ‘ঘোষিত হয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগের শেষ সিদ্ধান্ত নেবে রাজ্যগুলি। তা হলে আর ঝামেলা কী! কোনও রাজ্য যদি একে কাজে লাগায়, তবে তার একটা অভিজ্ঞতা হবে। ভাল অভিজ্ঞতা হলে অন্যেরা নেবে। খারাপ হলে সব শুদ্ধ বিসর্জনে যাবে’! |