মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে ‘শিল্পায়নের ঝড়’ তোলার চেষ্টা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক সেই সময়েই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে তাঁর অনড় বিরোধিতা রাজ্যে শিল্প সম্ভাবনার পথে বাধা তৈরি করছে বলে মনে করছে খোদ শিল্পমহল। মমতার যথেষ্ট উৎসাহ সত্ত্বেও দেশি-বিদেশি শিল্প সংস্থাগুলি এখনও পশ্চিমবঙ্গকে বিনিয়োগের উপযুক্ত গন্তব্য বলে মনে করতে পারছে না। অনেকেই মনে করছেন, আগামী জানুয়ারি মাসে মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা ছ’দিনের শিল্প-অধিবেশনেও এর ছায়া পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা মমতাকে নিয়ে শিল্পমহলে প্রথম দিকে কিছুটা হলেও সংশয় ছিল। বস্তুত, তাঁর আন্দোলনের ফলেই সিঙ্গুর থেকে ন্যানোর কারখানা গুটিয়ে গুজরাতে নিয়ে গিয়েছেন রতন টাটা। এই ঘটনার প্রভাব রাজ্যের শিল্প-মানচিত্রেও পড়েছিল। মমতা কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সিঙ্গুরে বিকল্প কারখানা গড়ার আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনার চেষ্টা করেছেন। তবু সাধারণ ভাবে বণিকসভা সূত্রে বলা হচ্ছে, সরকারের প্রতি পিছিয়ে পড়া কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের আস্থা থাকতে পারে, কিন্তু শিল্পমহলের আড়ষ্টতা এখনও কাটেনি। কারণ, এখনও পর্যন্ত মমতা যে সব প্রকল্প রূপায়ণে উদ্যোগী হয়েছেন, সেগুলি সবই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলের। তা সজ্জন জিন্দলের শালবনিই হোক বা নয়াচরে প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের প্রকল্প। নতুন শিল্প সংস্থার জন্য বড় মাপের জমি অধিগ্রহণ কী ভাবে হবে, তার রূপরেখা কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
এই প্রেক্ষাপটে আগামী ৯ জানুয়ারি থেকে কলকাতার মিলনমেলা প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে মমতার শিল্প অধিবেশন। চলবে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত। দেশ-বিদেশের শিল্প-প্রতিনিধিদের এখানে এনে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে ‘ভ্রান্তি’ দূর করতেই তৎপর হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যকে বিপণনের জন্য, তার ব্র্যান্ড তৈরির জন্য এর মধ্যেই লিনটাসের মতো বিজ্ঞাপন সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমন্ত্রিত শিল্প-প্রতিনিধিদের সামনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে ধরা হবে। |
অনিল অম্বানীর মতো শিল্পপতি এই সম্মেলনে আসতে রাজি হয়েছেন। এবং অ্যানিমেশন শিল্প থেকে বিদ্যুৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি উৎসাহ দেখাচ্ছেন। বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে অনিল যোগাযোগ রাখছেন মমতা-সরকারের সঙ্গে। মুকেশ অম্বানীও রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জানিয়েছিলেন, তিনি হলদিয়া পেট্রোকেম-এর অংশীদার হতে উৎসাহী। বিভিন্ন শিল্পপতিকে শুধু আমন্ত্রণ পাঠিয়ে ক্ষান্ত হয়নি রাজ্য সরকার। তাঁদের ব্যক্তিগত ভাবে ই-মেল করা হচ্ছে এই সম্মেলনে থাকার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে তার জবাবও আসছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক’জন আসবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ক’দিন আগেই দিল্লির প্রগতি ময়দানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় পশ্চিমবঙ্গ দিবসে ‘রাইজিং বেঙ্গল’ শীর্ষক আলোচনাসভা হয়। তার অভিজ্ঞতা থেকেই এই সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ, দিল্লিতে হলেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার পরিচিত মুখ প্রসূন মুখোপাধ্যায় ও সঞ্জয় বুধিয়ারাই। মুকেশ, অনিল কিংবা টাটা-বিড়লাদের মতো বড় মাপের শিল্পপতি কেউই সেখানে হাজির হননি। এমনকী, হর্ষ নেওটিয়া বা সঞ্জীব গোয়েন্কাদেরও ওই বৈঠকে দেখা যায়নি।
শিল্পমহল বলছে, শিল্পপতিদের আগ্রহের ব্যাপারে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, এমনকী পঞ্জাব-হরিয়ানার থেকেও পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। হরিয়ানাতে যেমন মিৎসুবিশির মতো সংস্থা আসছে, গুজরাতে উৎসাহ নিচ্ছেন অম্বানী ভাইয়েরা, যাচ্ছেন রতন টাটা। পশ্চিমবঙ্গের বেলায় এমন কেন ঘটে না? শিল্পমহলের একাংশের ধারণা, রাজ্য সরকার এখন পর্যন্ত যতই প্রচার করুক, জমি থেকে শুরু করে শিল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতি নিয়ে যত যুক্তিই দিক, শিল্পপতিদের সংশয় এখনও কাটেনি। এর পিছনে মমতার আন্দোলনের সঙ্গে রয়েছে বামপন্থীদের ৩৪ বছরের শাসনকালের ‘নেতিবাচক’ ইতিহাসও।
এ সব কাটাতেই ছ’দিন ব্যাপী শিল্প-অধিবেশন। যার নাম হওয়ার কথা ‘রাইজিং বেঙ্গল’ বা ‘বাংলা উদয়’। কিন্তু এই নামকরণ নিয়েও নানা মুনির নানা মত দেখা দিয়েছে। নাম যা-ই হোক, এই অধিবেশনের লক্ষ্য, শিল্পমহল তথা গোটা দুনিয়ার সামনে রাজ্যকে সুষ্ঠু ভাবে তুলে ধরা। এবং তার জন্য বেশ কিছু প্রদর্শনীও করা হবে। পশ্চিমবঙ্গে কেন বিনিয়োগ করবেন শিল্পপতিরা, প্রদর্শনীতে সেই বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা হবে। পাশাপাশি থাকবে বিভিন্ন আলোচনাসভা। সেখানে নারায়ণমূর্তি থেকে আজিম প্রেমজি, সকলকেই ডাকা হচ্ছে। ৭ ডিসেম্বর আজিম প্রেমজি কলকাতা আসছেন পার্থবাবুর সঙ্গে বৈঠক করতে। প্রেমজির সঙ্গে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হবে। যদিও বাম আমলে প্রেমজিকে দেওয়া জমি নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা এখনও মেটেনি। এই সরকারেরই এক পক্ষের বক্তব্য, একতরফা জমি না দিয়ে প্রেমজি কী করতে চান, তার একটা রূপরেখা আগে চেয়ে নেওয়া হোক।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে রাজ্যের শিল্পায়নের ব্যাপারে মমতা অবশ্য আগাগোড়াই ইতিবাচক। ক্ষমতায় এসেই তিনি শিল্পপতিদের নিয়ে একটি সম্মেলন করেছিলেন। সেখানে আদি গোদরেজ থেকে আইটিসি-র যোগী দেবেশ্বর, অনেকেই ছিলেন। এর পরে বিজয়া সম্মিলনী উপলক্ষে শিল্পপতিদের নৈশভোজেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মমতা। শিল্পমহল এখনও বলছে, এই ধরনের সম্মিলনীতেই শুধু হবে না। রাজ্যে বিনিয়োগের ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নিতে হবে মমতাকে। স্পষ্ট করতে হবে শিল্প থেকে জমি, কয়লা বা বিদ্যুৎ সংক্রান্ত নীতি। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম অবশ্য শিল্পমহলকে বোঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এর মধ্যেই জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে জয়পুরে প্রবাসী ভারতীয় দিবস সম্মেলন হবে। সেখানে উপস্থিত থাকবেন ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে আসার কথা চলছে। |
জমি-নীতি সম্পর্কে শিল্পোন্নয়ন নিগম জানাচ্ছে, তাদের হাতে ভাল পরিমাণ অধিগৃহীত জমি রয়েছে। জমি-মানচিত্রও রয়েছে তাদের। তবে এই জমির বেশির ভাগই বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মতো জেলায়, যেখানে মাওবাদীরা যথেষ্ট সক্রিয়। মাওবাদী দমনে মমতা অবশ্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছেন এবং সে জন্য শিল্পমহল খুশিও। কিন্তু শিল্পের জন্য যে বাতাবরণ প্রয়োজন, তা থেকে এই জেলাগুলি এখনও অনেকটাই দূরে। সঙ্গে রয়েছে উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব।
শিল্পকে ছাড়পত্র দেওয়ার মেয়াদও কমিয়ে এনেছেন পার্থবাবুরা। আগে যেখানে একটি শিল্পের ছাড়পত্র পেতে ৩১৭ দিন সময় লাগত, সেখানে এখন পনেরো দিনেই তা পাওয়া যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা সিআইআইয়ের প্রতিনিধিদলকে নিয়ে কলকাতার এই বাণিজ্য সম্মেলনের জন্য যে আগাম বৈঠক করেছিলেন, তাতেও শিল্পমহলে আশার আলো দেখা দিয়েছিল। কিন্তু খুচরো বিক্রয়ে তৃণমূলের অবস্থান আবার রাজ্য সম্পর্কে তৈরি প্রত্যাশায় জোর ধাক্কা দিয়েছে। খুচরো বিক্রয়ের পর কেন্দ্র যে পেনশন বিল আনতে চলেছে, তাতেও বিরোধিতা করা হবে বলে জানিয়েছেন দলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌগত রায়। তাতেও নৈতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
নীতিগত ভাবে যে এখনও পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিল্পপতিদের কাছে গন্তব্য হতে পারছে না, তার আরও একটা কারণ, মমতার বামপন্থীসুলভ আন্দোলনমুখিনতা। এই মন্তব্য করছেন বহু শিল্পপতিই। মমতা অবশ্য বলেছেন, রাজধর্ম পালনের নামে আর যা-ই হোক, তিনি আন্দোলনকে তাঁর জীবন থেকে বিসর্জন দিতে চান না।
এখন আন্দোলন এবং রাজধর্মের মধ্যে কী ভাবে মমতা ভারসাম্য রাখবেন, সেটাই অগ্নিপরীক্ষা। কারণ, সেই ভারসাম্য খুলে দিতে পারে বাংলার জন্য বিনিয়োগের দরজা। |