|
|
|
|
|
|
|
উল্টো পিঠের গান |
সৌমিত্রশংকর দাশগুপ্ত |
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল মুম্বই থেকে দমদম আসার পথে, প্লেনে উড়তে উড়তে।
ঠিক আলাপ হয়েছিল বলেও ব্যাপারটা বোঝানো যাবে না। যা হয়েছিল, তাকে আলাপ বলে না। কথা বলছিলেন উনি একাই, আমি হুঁ-হাঁ করছিলাম, এই পর্যন্ত।
ভোরের ফ্লাইট। ইন্ডিয়ান টাইমে কাল রাত দুটো নাগাদ ফিলাডেলফিয়া থেকে এসে ল্যান্ড করেছি। তার পর প্রায় ঘণ্টা তিনেক কেটে গিয়েছে এয়ারপোর্টেরই লাউঞ্জে। মুম্বই টু ক্যালকাটার এই ফ্লাইটটায় উঠে একটু ঘুমিয়ে নেব ভেবেছিলাম। উইন্ডো-সিট, অসুবিধে কিছু ছিল না। ভদ্রলোক আমার পাশের সিটটায়। চিনি না, ভাল করে মুখটাও দেখিনি। আলাপের কোনও চান্সই ছিল না। বাদ সাধল ফ্লাইট ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে কলকাতা থেকে আসা একটা মোবাইল কল। মিনিট দু’এক কথাবার্তা হয়েছিল। সেটা উনি ওভার-হিয়ার করেছিলেন। আর তার পরই শুরু করলেন গায়ে পড়ে আলাপ। উজাড় করে দিলেন ওঁর যাবতীয় মুগ্ধতা।
আপনারা ভাবছেন, এ তো ভালই। আমি নিশ্চয়ই একটা কেউকেটা লোক। কেউকেটা আমি ঠিকই। তবে সেটা আমার পেশার জগতে। আমি খুব বড় ইঞ্জিনিয়ার। গত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে ইউ এস এ-তে আছি। কাজ করেছি ওখানকার তাবড়-তাবড় ফার্মে। এখন আছি ফিলাডেলফিয়ায়। আপনারা যদি কখনও এখানে আসেন, এখানকার বেঙ্গলি বা ইন্ডিয়ান সোসাইটিতে রনু চ্যাটার্জি বললে সবাই একডাকে চিনবে। চিনবে হয়তো শিকাগোতেও। ওখানেও আমি বছর দু’এক ছিলাম। অবশ্য অনেক আগে। তবে ডেফিনেটলি চিনবে ক্যালিফোর্নিয়ায়, ম্যাসাচুসেটসে। অনেকে আমাকে প্রোফেসর বলেও জানেন। যদিও টিচিং আমার ঠিক পেশা নয়। তবে ভিজিটিং প্রোফেসর হিসেবে আমি ক্লাস নিয়েছি ও দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু, এই আই এ থ্রি নট থ্রি ফ্লাইটের ভদ্রলোকের মুগ্ধতা ঠিক আমার পেশার কারণে নয়। কারণটা অন্য। সেটা আমার বাবা।
আপনারা ভাবছেন, যেখানে ভদ্রলোক আমাকেই চেনেন না, সেখানে আমার বাবাকে উনি চিনবেন কী করে? উত্তরটা এই যে, নামটা করলেই আমার বাবাকে আপনারা অনেকেই চিনবেন। আচ্ছা, নামটা থাক। বরং একটা গানের লাইন বলি?
‘গুন গুন গুন অলি
তোরে কোন কথা যে বলি
ফুলের যত মধু
তুই একাই নিয়ে গেলি?’
চিনতে পারছেন? সিক্সটি-নাইনে নাইটিঙ্গেল রেকর্ড কোম্পানি থেকে বেরোনো অমিতা চ্যাটার্জির সুপার হিট গান। গীতিকার জয়দেব মিত্র, আর সুরকার...
‘আপনি সঞ্জয় চ্যাটার্জির ছেলে?’ ভদ্রলোকের চোখে-মুখে মুগ্ধতা উপচে পড়ল।
ফ্লাইট নাম্বার থ্রি নট থ্রি-তে ঠিক তক্ষুনিই মোবাইলের সুইচ অফ করার নির্দেশ এসে গিয়েছে। আমি আমার মোবাইল অফ করতে করতে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তার পর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
কিন্তু ভদ্রলোক ছাড়লেন না। বলতে লাগলেন, ‘আমি আপনার বাবার দারুণ দারুণ ফ্যান। নিজেও এক সময় তবলা বাজাতাম। কী সব যে সুর সৃষ্টি করে গিয়েছেন উনি! আর কী অর্কেস্ট্রেশান! ভাবাই যায় না। জানেন, এখনও রেডিয়োতে, পুজোর প্যান্ডেলে ওঁর কত
কত হিট গান বাজে। এখনকার কত আর্টিস্ট ওঁর সুরের গান স্রেফ রিমেক করেই ফেমাস হয়ে গেল!’
জানি। জানব না কেন? ফ্লাইট ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আমার মোবাইলে যে ফোনটা এসেছিল, সেটা সেই পুরনো নাইটিঙ্গেল রেকর্ড কোম্পানির। তবে এখন তো আর রেকর্ড বা ক্যাসেটের যুগ নেই, সিডি-র যুগ। ওরা ‘অল টাইম হিটস’ নামে বাবার সুরের চল্লিশটা গানের একটা সিডি অ্যালবাম লঞ্চ করছে। আজই সন্ধ্যায় আপনাদের শিল্পমন্দির সভাঘরে এই উপলক্ষে একটা সেলিব্রেশন হবে। থাকবেন আপনাদের চেনা অনেক সিঙ্গারস, মিউজিসিয়ান্স। পুরনো, যাঁরা বেঁচে আছেন, বাবার সঙ্গে কাজ করতেন, সঙ্গে নতুনরাও।
‘আপনি নিজে সিডি অ্যালবামটা লঞ্চ করবেন?’ ভদ্রলোক একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লেন। তার পর, ছেলেমানুষের মতো বললেন, ‘আমি যাব। নিশ্চয়ই যাব। আপনার সঙ্গে ওখানে দেখা করব।’
প্লেন ততক্ষণে নড়ে উঠেছে। পার্কিং বে ছাড়িয়ে রানওয়ের দিকে গটগট করে এগোচ্ছে। আমি আড়চোখে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম। আমারই বয়সি। মেরেকেটে বছর পঞ্চাশ হবে। চুল কিছু কাঁচা, কিছু পাকা। সুট-টাই পরা ঝকঝকে চেহারা। যত দূর মনে হয়, বিজনেসম্যান। প্লেন ছাড়ার আগে ওঁরও একটা কল এসেছিল। খুব মন দিয়ে অবশ্য কিছু শুনিনি। তবে যত দূর মনে হচ্ছে, বিজনেস-টকই হচ্ছিল।
‘আপনাকে আমরা কত খুঁজেছি!’ ভদ্রলোকের গলা আবেগে কাঁপছে। ‘আমাদের বন্ধুদের মধ্যে এক বার একটা বাজি হয়েছিল, জানেন? সঞ্জয় চ্যাটার্জির ছেলে সৃঞ্জয় চ্যাটার্জি। মিউজিসিয়ান।’
জানি। জানব না কেন? সবাই জানত মিউজিসিয়ান সৃঞ্জয় চ্যাটার্জিই বাবার ছেলে। দারুণ বঙ্গো বাজায়। আর ড্রামস। বাবার আসল ছেলের নাম কেউ জানত না।
আপনার নামটা যদি এক বার বলেন।
নীরস ভাবে বললাম, ‘আর চ্যাটার্জি’।
ও। ...আর আপনি...?
ইঞ্জিনিয়ার।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক বার একটা সিনেমার কাগজে যেন দেখেছিলাম, সঞ্জয় চ্যাটার্জির ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশে কোথায় যেন থাকেন...। শুনে অবশ্য একটু ইয়ে হয়ে পড়েছিলাম...
সাঁ করে প্লেনটা উঠে গেল আকাশে। আমি ঘড়ি দেখলাম। সবে ছ’টা পঁচিশ। ক্যালকাটা পৌঁছতে পৌঁছতে মিনিমাম ন’টা। এতক্ষণ ধরে পিতৃবন্দনা শুনে যেতে হবে নাকি?
আপনারা হয়তো ভাবছেন, সঞ্জয় চ্যাটার্জির ছেলে ইঞ্জিনিয়ার শুনে ইয়ে হয়ে পড়ার কী আছে? কিন্তু আমি দেখছি, মুখোমুখি কথাটা শুনলে আপনারা তো ইয়ে হয়েই পড়েন। আমি যখন প্রথম বিদেশে গেলাম, শিকাগোয়, তখন আমার বয়েস মাত্র পঁচিশ। সেখানকার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের হর্তাকর্তা ছিলেন ষষ্ঠিদা। ভদ্রলোকের আসল নামটা ভুলে গেছি। ওই নামেই তাঁকে সবাই ডাকত। প্রথম আলাপেই যখন তিনি আমার বাবার নাম জানতে চাইলেন, বললাম।
কী করতেন? না, মিউজিসিয়ান। মানে? সুরকার।
ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ! ‘ইউ মিন, সঞ্জয় চ্যাটার্জি, দ্য গ্রেট কম্পোজার!’
আমি মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়লাম।
ওঃ! হোয়াট আ গ্রেট মিউজিসিয়ান হি ওয়াজ! জিনিয়াস। সিম্পলি জিনিয়াস! আরে, ওঁকেও তো আমরা বছর দশেক আগে আমাদের অ্যানুয়াল ফাংশানে নিয়ে এসেছিলাম। আমার কাছে এখনও ওঁর অটোগ্রাফ রাখা আছে। কত ছবি আছে আমাদের অ্যালবামে! তা, ওঁর ছেলে
হয়ে তুমি এই লোহা-লক্কড়ের লাইনে কেন, ভাই?
বুঝুন! ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেল লোহা-লক্কড়েরর লাইন!
বললাম, ‘আপনি নিজেও তো এই লাইনেই।’
আরে, তা বলে আমি কি সঞ্জয় চ্যাটার্জির ছেলে নাকি? আমার বাবা ছিলেন মার্চেন্ট অফিসের কেরানি। কেরানির ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, এই না ঢের! তা বলে সঞ্জয় চ্যাটার্জির ছেলে... ওঃ! কী সব দুর্দান্ত হিট গান! সেই ‘সাগর সৈকতে’ সিনেমায় সোমা দত্তর লিপে নীল সাগরের জলে/ভিজিয়ে মাথার চুল/আয় তোরা সব দেখে যা রে/চুল হারানোর ভুল... কী রোমান্টিক সিন! তার পর, ওই ইয়েটা...
তখন থেকে আমার পরিচয় সঞ্জয় চ্যাটার্জির ছেলে। আমাকে গান গাওয়ানোর জন্য সে কী ঝুলোঝুলি! বছর দু’এক কোনওক্রমে কাটিয়ে বিরক্ত হয়ে শিকাগো ছাড়লাম আমি।
‘আপনার বাবার ঠিক কী হয়েছিল?’ ভদ্রলোকের প্রশ্নে একটু চমকে উঠলাম আমি।
নীচে মুম্বই নগরীর ঘরবাড়ি ততক্ষণে সম্পূর্ণ অদৃশ্য। কিঁ-কিঁ করে একটা শব্দ হচ্ছিল আমার কানে। বোধ হয় সামান্য তালা ধরে গিয়েছিল। ভদ্রলোকের প্রশ্নটা, মনে হল, পাশের সিট থেকে নয়, অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিল।
মাত্র আটচল্লিশ বছরে মৃত্যু!... ভাবা যায় না। অথচ, বেঁচে থাকলে... ঠিক কী হয়েছিল ওঁর?
সংক্ষেপে বললাম, ‘হার্ট অ্যাটাক’।
ও। কিন্তু, তখনকার একটা সিনেমার কাগজে লিখেছিল.. অবশ্য... হতে পারে ওটা গুজব... |
|
আমি চুপ করে রইলাম। একটু একটু হাসিও পাচ্ছিল। বাবার মৃত্যুর সময় আমার বয়েস কুড়ি। সবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। তখনও আমাকে বন্ধুরা এই প্রশ্নটাই করেছিল। সেই সময়ের দু’তিনটে খবরের কাগজেও লিখেছিল, হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তারের রিপোর্টেও তাই লেখা ছিল। কিন্তু সিনেমার কাগজগুলো অন্য গপ্পো ফাঁদল। কেউ বলল, সিরোসিস অব লিভার। কেউ বলল, ব্লাড ক্যান্সার। বাবার মৃত্যু হয়েছিল ঘুমের মধ্যে। সেজন্যই হয়তো ‘সা রে গা’ নামে একটা গানের পত্রিকা ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইডের গল্পও বলল। আর সবচেয়ে মজার কথা, হাওড়া স্টেশনে, শেয়ালদায়, কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এই সব পত্রিকাগুলোই হট কেকের মতো সেল হয়ে গেল। কাজেই আমি যখন বললাম, হার্ট অ্যাটাক, আমার কলেজের বন্ধু-বান্ধবীরাও মুচকি হেসেছিল। বাবার ছেলের কথা টেকেনি, টিকেছিল ওই যত্তসব উল্টোপাল্টা গপ্পো!
স্যর, টি অর কফি?
একটু চমকে উঠলাম। দেখলাম, সিটের মাঝখানে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে হাস্যমুখী এয়ার হোস্টেস।
নো, থ্যাঙ্ক ইউ।
খান না একটু। পাশের ভদ্রলোক বলে উঠলেন। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আই শ্যাল পে।
কেন? মে আই নো, হোয়াই? লোকটা তো বড্ড জ্বালাচ্ছে।
কী যে বলেন! ইটস মাই প্লেজার। আপনি সঞ্জয় চ্যাটার্জির ছেলে! বাংলা গানে আমার মোস্ট মোস্ট ফেভারিট সুরকার।
ওঃ! কী কুক্ষণেই যে প্লেন ছাড়ার আগে মোবাইলে ফোনটা এসেছিল!
ফোনটা করেছিল কৌশিক। ম্যাসাচুসেটসে আমার ছাত্র ছিল। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচ ডি করে ও এখন নাইটিঙ্গেল রেকর্ড কোম্পানির সিনিয়র ম্যানেজার। বলতে কী, ও-ই আমাকে ব্যাপারটাতে জড়িয়েছে। আসছিলাম যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে একটা কনফারেন্সে। কৌশিকের বাড়ি যাদবপুরেরই ধারে-কাছে। সে জন্য ওকে একটা ই-মেল করেছিলাম। ও সেই সুযোগে আমাকে বাবার সুরের অল টাইম হিটস সিডি-অ্যালবামটা লঞ্চ করার রিকোয়েস্ট করে। এর আগেও আমাকে বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানি থেকে এ রকম অনেক রিকোয়েস্ট করেছে। আমি পাত্তা দিইনি। অনেক দিনই বাবার সুর করা সমস্ত গানের রয়্যালটি আমি বাবারই হাতে তৈরি গানের স্কুল ‘সুরবীথি’কে লিখে দিয়েছি। বাবার কাছ থেকে আমি আর কিছু নিই না। কিছু দিতেও চাই না। কৌশিকের জন্যই জড়িয়ে পড়লাম।
আচ্ছা, অল টাইম হিটস-এ ওই গানটা থাকছে তো?
প্লেনটা তখন মেঘের একটা টানেলের ভেতর দিয়ে চলেছে। আমি মন দিয়ে সেটাই দেখছিলাম। ভদ্রলোকের কথায় একটু চমকে উঠে বললাম, ‘কোন গানটা?’
ওই যে
‘মনের ভিতর মন/ খোঁজে অরূপ সে রতন...’ সেভেন্টি ওয়ানের পুজোয় অমিতা চ্যাটার্জির সুপার হিট গান?... জানেন, তখন তো বয়েস খুব কম, বন্ধুদের সঙ্গে সারা রাত্তির ঘুরে ঠাকুর দেখছি, সপ্তমীর রাতে গুনে গুনে বাইশটা পুজো-প্যান্ডেলে ওই গানটা বাজতে শুনেছি।
আছে হয়তো। ঠিক জানি না।
‘ও।’ ভদ্রলোক যেন একটু চুপসে গেলেন।
গানটা কিন্তু আছে, আমি জানি। কৌশিক আমার ই-মেলে গানের পুরো লিস্টটাই পাঠিয়ে দিয়েছে। শুনেছি, নাইটিঙ্গেল স্টুডিয়োতে ওই গানটা টেক করতে নাকি প্রায় আধ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। তখন তো লাইভ রেকর্ডিংয়ের যুগ। অমিতাপিসির এক্সপ্রেশন নাকি বাবার কিছুতেই পছন্দ হচ্ছিল না। প্রায় কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন পিসিকে। ও দিকে বাড়িতে আমার তখন ধুম জ্বর। প্যরাটাইফয়েড। হুঁশ প্রায় ছিলই না আমার। মা মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছিলেন। বাবা বলে গিয়েছিলেন, রেকর্ডিং থেকে ফেরার সময় আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডাক্তার মিত্রকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু কোথায় বাবা? তখন তো আর মোবাইলের যুগ আসেনি, মা বাড়ি থেকেই স্টুডিয়োতে কয়েক বার ফোন করেছিলেন। বাবা একটা কলও ধরেননি। উল্টে স্টুডিয়োর ম্যানেজার মাকে নাকি বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম, আপনি এ ভাবে ফোন করবেন না, প্লিজ! সঞ্জয়বাবু বিরক্ত হচ্ছেন।’
সুপারহিট গান। আপনারাও জানেন। এখন রিমেক হচ্ছে। এই সে-দিন আমাদের ওখানের বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে একটি মেয়ে, কী যেন নাম, গানটা গেয়ে হাততালিতে ভেসে গেল। স্টেজ থেকে নেমেই ঢিপ করে আমাকে একটা প্রণাম! কী বলব! যে বাইশটা পুজোপ্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে আমার পাশের এই ভদ্রলোক গানটা শুনেছিলেন, তার একটাতেও আমি সে বার ঘুরতে পারিনি। অসুখ থেকে উঠে গায়ে জোরই ছিল না আমার। ডাক্তার মিত্র বলেছিলেন, আমাকে পুরী বা গোপালপুরের সি-সাইড থেকে একটু ঘুরিয়ে আনতে। ট্রেনের টিকিটও কাটা হয়েছিল। কিন্তু যাওয়ার দু’তিন দিন আগে তখনকার ম্যাড্রাস ফিল্ম সোসাইটি থেকে বাবার একটা কল এল। একটা তামিল ছবিতে সুর করতে হবে। বাবা চলে গেলেন। আমি মায়ের সঙ্গে পুরী গেলাম।
আমার মাকে আমি অনেক বার কাঁদতে দেখেছি। অনেক বার। পুরীতে গিয়েও মাঝরাতে মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। বাবার সুরের যে সব গান শুনে আপনারা মাতামাতি করেছেন, আশ্চর্যের বিষয়, তার একটাও আমার মাকে কোনও দিন গুনগুন করতেও শুনিনি। অথচ, আপনারা কি জানেন, আমার মা-ও খুব ভাল গাইতেন? রেডিয়ো আর্টিস্ট ছিলেন। দু’চারটে রেকর্ডও আছে মায়ের। বাবারই সুরে। বাবার তখন উঠতি বয়েস। সবে একটু একটু নাম হচ্ছে। মা বাবার কাছে গান শিখতেন। সেই সূত্রেই প্রেম, তার পর, বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে। খুব বড়লোক ছিলেন আমার দাদামশাই। বিশাল ব্যবসা। তাঁর মেয়ে ছোকরা গানের মাস্টারের সঙ্গে পালিয়ে গেছে শুনে মাকে প্রায় ত্যাজ্য করে দেন। তার পর বাবার অনেক নাম হয়েছে, পয়সাও, কিন্তু মায়ের জন্য বাপের বাড়ির দরজা আর খোলেনি। মা ও বাড়িতে গিয়েছিলেন দাদামশাইয়ের মৃত্যুর পর। আর বাবা? এক দিনও না। মামারা মেটানোর চেষ্টা করেছিলেন। মেটেনি।
অথচ বিয়ের পর এই মাকেই আর একটাও গানের সুর করে দেননি বাবা। তখন সমস্ত হিট সুর পাচ্ছে মায়েরই বান্ধবী করবী মিত্র। তখনকার সিনেমায় হিরোইন মণিকা বা জয়িতার লিপে সেই সব গান শুনে আপনারা দিওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। এক বার এক জন ডিরেক্টর মণিকার একটা সিনে মাকে দিয়ে একটা গান করানোর জন্য বাবাকে ঝুলোঝুলি করেন। বাবা এককথায় খারিজ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ভয়েস ম্যাচ করবে না।’ কথাটা হয়তো সত্যি। কিন্তু মা খুব আঘাত পেয়েছিলেন। করবী মিত্রর গলায় সেই গানও হিট হয়েছিল।
আবার এই করবী মিত্রকেও একটা সময়ের পর বাবা ছেড়ে দিয়েছেন। ইন্ডাস্ট্রিতে এ জন্য বাবার খুব সুনাম ছিল। সবাই বলত, ‘সঞ্জয়বাবু কক্ষনও কম্প্রোমাইজ করেন না।’ ঠিকই। সিনেমায় মণিকা-জয়িতাদের পর্ব তখন প্রায় শেষ। উঠে আসছে এক ঝাঁক নতুন নায়িকা। ঋদ্ধি, সুহিতা, পিয়ালি। এদের জন্য গানে নতুন ভয়েস চাই। তখনই করবী মিত্রকে সরিয়ে জায়গা করে নিল অমিতা চ্যাটার্জি। অমিতা পিসি। পিসিকে দিয়ে ‘নীল রাত্রি’ নামে প্রথম যে সিনেমার গানগুলো তৈরি হল, তার যে কোনও একটার নাম করলেই আমার পাশের ভদ্রলোক নির্ঘাৎ সিট বেল্ট খুলেই লাফিয়ে উঠবেন। ইনি বাবার যে রকম ফ্যান! অথচ, ফার্স্ট উইকে ছবিটার রিপোর্ট ভাল ছিল না। চিত্রালি, পুবালি, মঞ্জুষা কলকাতার তিন তিনটে সিনেমা হলে প্র্যাক্টিক্যালি মাছি তাড়িয়েছিল। কাগজের রিভিউও ভাল ছিল না।
সেই সময় এক দিন বাবা অনেক রাতে বাড়ি ফেরেন। চূড়ান্ত মাতাল। বাবা ড্রিঙ্ক করতেন, তবে মাত্রার বাইরে নয়। কিন্তু সে রাতে মা কী একটা বলতেই মাকে মারলেন প্রথম একটা ধাক্কা। মশারির দড়ি ছিঁড়ে মা পড়ে গেলেন প্রায় আমার ঘাড়ের ওপর। ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। দেখলাম, বাবার ভয়ঙ্কর উগ্র মূর্তি। অথচ হপ্তা দুই যেতে না যেতেই মিরাকল! ছবি এবং গান দুটোই হিট হয়ে গেল। অল টাইম হিটস-এ এই সব গানও থাকছে। সঙ্গে পরিচয়লিপিতে লেখা হয়েছে এই সব গান এক ইতিহাস। সঙ্গীতজগতের মাইলস্টোন।
তা তো বটেই। নিজের কেরিয়ারে এ রকম একটার পর একটা মাইলস্টোন পেরিয়ে গিয়েছেন আমার বাবা। আর পেছনে ফেলে গিয়েছেন আমাদের মতো অনেক জনকে। আপনারা শুধু গান শুনেছেন, আর পাগল হয়েছেন। খোঁজ নিয়েছেন আমাদের কারও? আমার মায়ের? কী ভাবে বাবার আচমকা মৃত্যুর পর আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে শেষে এক দিন নিজেই কাগজে চার লাইনের একটা খবর হয়ে গেলেন। খোঁজ করেছেন করবী মিত্র? অমিতা পিসির? করবীর পর অমিতা, আর অমিতারও পর তামিল সিঙ্গার চিন্তামণি। বাংলা শিখে বাবার সব হিট সুরগুলো তখন সে-ই পাচ্ছে। আপনারা কি জানেন, বাবার কাছ থেকে চূড়ান্ত অবহেলা পেয়ে অমিতা পিসির মাথারই একটু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল? ...কী আর জানেন আপনারা? রেকর্ডের যে পিঠের গানটা হিট হয়, শুধু সেটাই শোনেন, আর তার উল্টো পিঠটা? ছুঁয়েও দেখেন না।
টুং টাং করে যেন পিয়ানো বেজে উঠল আই এ থ্রি নট থ্রি ফ্লাইটে। এয়ারহোস্টেসের গলা শোনা গেল। প্লেন এখন কলকাতার আকাশে। নামছে একটু একটু করে। অনেক নীচে খেলনার মতো দেখা যাচ্ছে বাড়িঘর। পিঁপড়ের সারির মতো ট্রাফিক চলছে। কানে আবারও তালা লেগে গেল হঠাৎ। নেমেই ছুটতে হবে যাদবপুর। চারটে পর্যন্ত ওখানের কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় শিল্পমন্দির সভাঘর। যেতেই হবে। ওরা কাগজে খুব বড় করে অ্যাড দিয়েছে। বিশাল হোর্ডিং টাঙিয়েছে হাজরায়, রাসবিহারীতে, শ্যামবাজার পাঁচ-মাথার মোড়ে। এই প্রথম বাবার নামের সঙ্গে আমার নাম। হয়তো এই শেষ।
একটা কথা জানা হল না ভদ্রলোক বলে উঠলেন।
বলুন।
আপনি নিজে গানটান...?
মাথা নাড়লাম। না।
আপনার ওয়াইফ...?
শি ইজ অ্যান অ্যামেরিকান লেডি।
ছেলেমেয়ে...?
একটিই ছেলে। বাংলা গানের কিছু জানে না।
রানওয়ে পার হয়ে প্লেন এসে পৌঁছে গেছে পার্কিং বে-তে। রাইট টাইম। সিট বেল্ট খুলে লাইন দিয়ে নামছি, হঠাৎ ভদ্রলোক একটা নোটবুক এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কিছু যদি মনে না করেন...’
অ্যাড্রেস?
না। আপনার একটা অটোগ্রাফ।
মানে?
আমার মেয়েকে দেখাব। ও গান করে। আপনি সঞ্জয় চ্যাটার্জির ছেলে।
মুহূর্তের জন্য মুখ লাল হয়ে উঠল আমার। সামলে নিয়ে বললাম, ‘সরি। এ ভাবে আমি কাউকে অটোগ্রাফ দিই না।’
...আমি কি শুধু আমার বাবারই ছেলে? |
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|