শিরদাঁড়া ভেঙে অর্ধেক কোমায় চলে গিয়েছেন বছর পঁয়ত্রিশের মানসিক রোগগ্রস্ত যুবকটি। হাত-পা-চোখ নড়ছে না। আপনা থেকে মলমূত্র হয়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। কিন্তু গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরে এক সপ্তাহ কেটে গেলেও লুম্বিনী মানসিক হাসপাতালে ভর্তি ওই যুবকের এমআরআই-ও করানোর প্রয়োজন মনে করেননি কর্তৃপক্ষ। শুধু তা-ই নয়, ঘটনার দু’দিন পরে তাঁকে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যাপারে টনক নড়ে লুম্বিনী কর্তৃপক্ষের। কিন্তু, পরপর তিন সরকারি হাসপাতাল মরণাপন্ন সেই রোগীকে ভর্তি না করে ফেরত পাঠায়। আপাতত মানসিক হাসপাতালে পড়ে থেকে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন ওই মনোরোগী যুবক।
মুমূর্ষু রোগীকে ফেরানো যাবে না, এই মর্মে বারংবার নির্দেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। নির্দেশ দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। চিকিৎসক তথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তিনি সহানুভূতিশীল ও দায়বদ্ধ হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও যে চিকিৎসকদের একাংশের দায়িত্বহীনতায় ছেদ পড়েনি, লুম্বিনীর ঘটনা তারই আর একটি উদাহরণ বলে মনে করছে স্বাস্থ্য দফতর।
সহ স্বাস্থ্য-অধিকর্তা (মানসিক স্বাস্থ্য) সচ্চিদানন্দ সরকারের কথায়, “মনোরোগীদের মানসিক হাসপাতাল থেকে অন্য কোথাও রেফার করলে ভর্তি করতেই হবে। সেটাই স্বাস্থ্য দফতরের গাইডলাইন। কেন জানি না, মনোরোগী শুনলেই কোনও হাসপাতাল আর ভর্তি করতে চায় না। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীকে ফেরানো হচ্ছে, এটা ভাবা যায় না।” ঘটনার কথা জানিয়ে স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে চিঠি লিখেছে কেন্দ্রের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক নীতি নির্ধারণ কমিটি। কমিটির সদস্য রত্নাবলী রায়ের কথায়, “মানসিক রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বারবার বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা অধিকার ভঙ্গের পর্যায়ে পড়ে, যা বরদাস্ত করা হবে না।” |
লুম্বিনীর শয্যায় রঞ্জিত দাস |
গত ২৫ নভেম্বর লুম্বিনী হাসপাতালে খাট থেকে বেকায়দায় পড়ে গিয়ে শিরদাঁড়া ভেঙে যায় মনোরোগী রঞ্জিত দাসের। নিমতার বাসিন্দা রঞ্জিত তিন বছর ওই হাসপাতালে আছেন। আঘাত গুরুতর হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল তাঁকে টানা দু’দিন সামান্য কিছু ওষুধ দিয়ে ফেলে রাখে বলে অভিযোগ। সুপার কালীদাস দত্ত ছুটিতে বলে হাসপাতাল থেকে এমআরআই-এর টাকা দেওয়া হয় না। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, চিকিৎসার অভাবে রঞ্জিত প্রায় কোমায় চলে যান।
কেন তখনই রঞ্জিতকে হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা বা এমআরআই হল না? দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “অবস্থা এতটা খারাপ হবে, বোঝা যায়নি। এমআরআই-এর টাকা কী ভাবে জোগাড় হবে, বোঝা যাচ্ছিল না।” অবশেষে লুম্বিনী কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। সোমবার, ২৮ নভেম্বর থেকে রঞ্জিতকে অন্য হাসপাতালে ভর্তির জন্য ঘোরাঘুরি শুরু হয়।
প্রথমে বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি (বিআইএন), তার পরে এসএসকেএম ও সব শেষে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ মরণাপন্ন রঞ্জিতকে ভর্তি না-করে ফিরিয়ে দেয়। কেন? বিআইএন কর্তৃপক্ষের জবাব, “আমাদের ইমার্জেন্সি নেই। ভর্তি করা যাবে না। এসএসকেএমে যান।” এসএসকেএম জানায়, শয্যা নেই। তা ছাড়া, ওই রোগীর এমআরআই তারা করতে পারবে না, কারণ সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও সেখানে এমআরআই এখনও চালু হয়নি। আর ন্যাশনাল মেডিক্যালের সুপার পার্থ প্রধানের বক্তব্য, “আমাদের নিউরোসার্জারি ইমার্জেন্সি নেই। এমআরআই-ও নেই। সার্জারি বা মেডিসিন বিভাগেও কোনও শয্যা খালি নেই, যেখানে রোগীকে নেওয়া যাবে।”
তা হলে রঞ্জিতের কী হবে? লুম্বিনী হাসপাতালের আধো-অন্ধকার ঘরে নিঃসাড় ভাবে পড়ে থাকা রঞ্জিত সম্পর্কে স্বাস্থ্যকর্তারা কেউ কোনও উত্তর দিতে পারেননি। |