পুস্তক পরিচয় ২...
বুঝতে পারেনি অদৃশ্য ধীবরের চতুরালি
মৃত্তিকা, স্বাতী গুহ। প্রতিভাস, ১৫০.০০
জলরঙ্গ, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়। বিকাশ গ্রন্থ ভবন, ৫০.০০
চৈতালি-কেয়ার কথা, চৈতালি দাশগুপ্ত। সপ্তর্ষি, ১৫০.০০
হাভারতে খাণ্ডবদাহনকালে আগুন এবং জলের এক লড়াই চলে। তাতে শেষ পর্যন্ত ঘটে সেই বিস্ময়কর ঘটনা আগুনে দগ্ধ হয় জল। আর এরই মাঝে জেগে থাকে মৃত্তিকা, বসুন্ধরা; বৃষ্টির জলে ভিজে, রোদের আগুনে পুড়ে স্বাতী গুহর মৃত্তিকা-র বারোটি অধ্যায়ে। এক জন চিত্রকর ও এক নারীর সংলাপ চলে বারোটি অধ্যায় জুড়ে। এই নারীর নাম মৃত্তিকা, শিল্পী তাকে ডাকে মাটি। যদিও শিল্পী নিজে নামহীন। প্রথম দিকের অধ্যায়গুলি যে ভাবে এগোয়, তাতে মনে হয়, মৃত্তিকা আসলে শিল্পীরই মানসপ্রতিমা, ক্যানভাসে যে-ছবি জন্ম নেয়, তারই সম্প্রসারণ। কিন্তু ক্রমশ সংলাপগুলি সামান্য হলেও ভাবের আকাশ ছেড়ে কঠিন বাস্তবে নেমে আসে। দ্বন্দ্বের ছোট ছোট বৃত্ত তৈরি হয়। মৃত্তিকার চাকরির নানা কমিটমেন্ট এবং শিল্পীর স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাগুলির মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকে। আরও কয়েকটি চরিত্রের উল্লেখ মেলে, কিন্তু সেই অবয়বগুলি কুয়াশায় ডুবে থাকা পটভূমি থেকে জেগে উঠে আবার সেখানেই তলিয়ে যায়। শিল্পীর প্যাশন এবং বাস্তবের দাবির ঘর্ষণে জ্বলে ওঠা আগুনের ফুলকি ইন্ধনের অভাবে হারিয়ে যায়, বরং ‘তাই তো মাটি, আজও তোমাকে দেখলে আমার জল হতে ইচ্ছে করে’-র ধ্রুবপদ এক অন্য আগুনে মেশে। শিল্পীর নারীকে চাওয়া, শিল্পকে চাওয়া একাকার সেই আগুনে।
রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে জয় গোস্বামী মিশে আছেন স্বাতী গুহর গদ্যের নির্মাণে। তবে ‘মৃত্তিকা’র পায়ের তলার মাটিটা আরও কিছুটা শক্ত হলে তাতে ভর দিয়ে দাঁড়ানো সহজ হত। স্পষ্ট হল না, শিল্পীর নন্দনবোধের জগৎ নাকি বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে কল্পনার সংঘাত, কিংবা নিছক এক প্রেমের উপাখ্যান, কী প্রতিপাদ্য।
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের জলরঙ্গ-ও এক মেয়ের আপনকথা। লেখিকা একে বলেন এক মেয়েলি ভ্রমণ কথা অথবা হলে হতে পারত উপন্যাস মানবীহত্যার। কেন্দ্রীয় চরিত্র সুনন্দা একটি উপন্যাস লেখার চেষ্টা করে ‘মীনমঙ্গল’। ছেলেবেলায় শান্তিনিকেতনে মীনমঙ্গল অনুষ্ঠান দেখেছে সে, সেখানে ঘটা করে মাছের চারা ছাড়া হয় জলে। কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে সে জানে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা আসলে একটা বিপুল সামাজিক ধোঁকাবাজি, আদতে, জলের শস্যরা যাতে তাদের পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য নিয়ে রসনার উপযুক্ত হয়ে ওঠে, তারই এই ব্যবস্থা। ঠিক যেমন ভাবে সুনন্দার পিসিমা, মা, কাকিমা, দিদিরা সংসারের জলাশয়ে মাছের মতো খেলা করেছে, তারপর এক সময় পিতৃতন্ত্র বিশাল জাল হয়ে ঘিরে ধরেছে তাদের, প্রাণরক্ষার তাগিদে নিজেরাই নিজেদের শত্রু ভাবতে শুরু করেছে, তবু বুঝতে পারেনি অদৃশ্য ধীবরের চতুরালি। সুনন্দা তার উপন্যাসের আশালতা, বনলতা, স্বর্ণলতার সঙ্গে একাত্ম। সত্য ও কল্পনার ন্যূনতম ব্যবধানরেখা থাকে না। ঘুচে যায় ‘মীনমঙ্গল’ এবং ‘জলরঙ্গ’র ব্যবধানও। জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা বলে যায় স্বর্ণলতা ওরফে পুষি, সুনন্দা এবং ফ্রেমের এপারে থাকে চৈতালীও। পাঠককে তা যেন আড়ি পেতে শুনতে হয়।
আর এখানেই কিছুটা সমস্যা হয়। চিন্তার স্রোতে অতীত-বর্তমান, স্বপ্ন-বাস্তব মিলেমিশে থাকে, সেটা পাঠককে ধরিয়ে দিতে গেলে অন্তত একটা প্যাটার্ন দরকার, যুক্তিহীনতারও একটা যুক্তি থাকাটা জরুরি। একটি চরিত্র আর একটির মধ্যে কখন যে ঢুকছে, আবার কখন বেরিয়ে যাচ্ছে সেটা কখনও কখনও বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ঘনিষ্ঠজনেদের গোপন সম্পর্ক নগ্ন করা যে ভীষণ ভাবে তসলিমাকে মনে পড়ায়, তা কি নেহাতই আপতিক!
স্বপ্নে-সত্যে মেশানো শিল্পীর কল্পনা থেকে এক নারীর আত্মবিবৃতির সূত্রে একটির পর একটি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। স্বাতী গুহর মৃত্তিকা এবং চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের জলরঙ্গ-র পর আর এক চৈতালী চৈতালী দাশগুপ্তর চৈতালি-কেয়ার কথা-কে সেই সম্প্রসারিত পথ চলার সূত্রেই হয়তো গাঁথা যেতে পারে। এ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, একই নারীসত্তার দ্বিমুখী প্রকাশ।
যুগ বদলালেও অবস্থাটা যে বিশেষ বদলায়নি, সে কথা আরও এক বার প্রমাণ করে চৈতালি দাশগুপ্তর স্মৃতিকথা। নিজের পোশাকি এবং ডাকনাম দু’টিকে সুকৌশলে ব্যবহার করেছেন লেখিকা তাঁর ঘরে-বাইরের জীবনের একাধারে দ্বন্দ্ব এবং ঐক্যকে বোঝাতে। চৈতালির বাচিক শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ কলকাতা দূরদর্শনের জন্মলগ্ন থেকে। এই বই উসকে দেবে সেই সব দিনের কথা, যখন একমাত্র বাংলা চ্যানেলের অন্যতম ঘোষিকা-সঞ্চালিকা পৌঁছে গিয়েছিলেন বাঙালির অন্দরমহলে। সেই হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনি ধরা আছে এই বইতে। সেই সঙ্গে লেখিকা অকপটে উন্মুক্ত করে দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত আঘাতের ক্ষতচিহ্নগুলিকে। এক সময় ইচ্ছে ছিল, কন্যাসন্তান জন্মালে নাম রাখবেন ‘শ্রাবস্তী’, শৈল্পিক তাগিদ এবং প্রয়োজনের দাবিতে শুরু হয়েছিল যে-বুটিক, তার নাম দেন সেই অজাত কন্যার নামে। একে অবলম্বন করে নতুন উদ্দীপনায় বাঁচেন, অতিক্রম করতে সক্ষম হন পরিণত বয়সের দুঃখগুলিকে।
চৈতালির স্মৃতিকথা নানা ঘটনার বিবরণে, বহু বিখ্যাত ব্যক্তির টুকরো ছবিতে পাঠকের কৌতূহলকে জাগিয়ে রাখে, তবে মাঝে মাঝেই কালানুক্রমিকতা হারিয়ে যাওয়ায় তৈরি হয় বিভ্রান্তি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার ভুল উদ্ধৃতি (পৃ: ৭০) প্রায় অবিশ্বাস্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.