|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
বাংলা হেরে গেল আধ-ডজন গোলে |
ইন্দ্রজিৎ রায় |
খেলা যখন ইতিহাস: সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি; কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেতু প্রকাশনী, ১০০.০০ প্লেয়িং ফর ফ্রিডম: আ হিস্টরিক স্পোর্টস ভিকট্রি,
কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়। স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স (ইন্ডিয়া), ৪৯৫.০০ |
একশো বছর আগে মোহনবাগান প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আই এফ এ শিল্ড জেতে। এগারো জন বাঙালি খালি পায়ে খেলে বুট-পরা গোরাদের দল ইস্ট ইয়র্কস’কে ২-১ গোলে হারায়। পরাধীন দেশে এ হেন বিজয়, হোক না তা খেলার মাঠে, যে ভিন্ন মাত্রা পাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গভঙ্গ, জালিয়ানওয়ালাবাগ-এর মতো ইতিহাসের যে-সব সন-তারিখ মনে রাখতে হয়, তার মধ্যে শিল্ডবিজয়ও অন্তর্ভুক্ত। এই ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে, বিশেষত গত দুই দশকে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন প্রজন্মের ইতিহাসবিদ। অতএব, তাঁর কলমে শতাব্দীপ্রাচীন বহুচর্চিত বিষয়েরও আধুনিক বিশ্লেষণ পাব, তা ধরে নিয়েই আলোচ্য বই দু’টি পড়তে বসেছিলাম।
খেলা যখন ইতিহাস ছয়টি প্রবন্ধের সংকলন। দ্বিতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম ‘মোহনবাগান ১৯১১: জাতীয়তাবাদী গৌরব না ক্রীড়াসাফল্য?’-ই বলে দেয় কৌশিক আলোচনার মোড় কোন দিকে ঘোরাতে চান। দক্ষ ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি প্রথমেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে নেন আমাদের জানান তখন কেমন ছিল বাংলা তথা ভারতের ফুটবল; তারপর গল্পের মতো বিবরণ দেন সেই দিনটির। প্রবন্ধটি পড়তে ভাল লাগে, অনেক অজানা তথ্যও জানতে পারি।
প্রথম প্রবন্ধে ইতিহাসের চাকা আরও পেছনে ঘুরেছে। এটিতে ‘ভারতীয় ফুটবলের জনক’ হিসেবে নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর ভূমিকা আলোচিত। ১৮৭৭-এ নগর কলকাতায় কী ভাবে খেলাটার ‘কিক-অফ’ হল, তারই ইতিহাস। লেখক প্রমাণ করেছেন ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের গোড়ায় বাঙালি ছিল দুর্বল, বাঙালির খেলাও ছিল ‘সেডেন্টারি’। কলকাতার পার্কে নগেন্দ্রপ্রসাদের ফুটবল কিক যেন বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর পর্বের সূচনা, যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই চৌত্রিশ বছর পরে মোহনবাগানের শিল্ডজয়। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা-তেও একই ইতিহাসের প্রমাণ ‘‘তখন খেলা ছিল সামান্য কয়েক রকমের।...শহর ছেলেদের খেলা সবই ছিল এমনি কমজোরি। মাঠ-জোড়া ফুটবল খেলার লম্ফঝম্প তখনো ছিল সমুদ্রপারে।’ তবে এখানে তর্ক হতে পারে দু’টি কারণে। প্রথমত, শহরের ছেলেদের খেলা কমজোরি হলেও রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন ‘পালোয়ান’... মুগুর ভাঁজত মস্ত ওজনের; দারোয়ান... কুস্তির প্যাঁচ কষছে;... ডন ফেলছে বিশ-পঁচিশ বার ঘন ঘন।” ছেলেবেলা-তেই গল্প আছে সাঁতার বা ডাকাতের রন্পা-র। যদি ধরেও নিই এই সব পালোয়ান, দারোয়ান বা ডাকাতরা ঠিক ‘বাঙালি’ বা ‘খেলোয়াড়’ নন, তা সত্ত্বেও আধুনিক ডাকাবুকো শহুরে খেলারও চল ছিল বইকী; উদাহরণ হিসেবে, স্বয়ং জ্যোতিদাদাই ‘ঘোড়ায় চড়তে ভালবাসতেন... বন্দুক ছোঁড়া কস্ত করেছিলেন’। |
|
এ দুটি প্রবন্ধ শেষ করে মনে হতে পারে, বইয়ের বিষয়বস্তু মোহনবাগান তথা বাঙালির জয়ের ইতিহাস। পাঠককে এখানেই লেখক হতাশ করেন। দ্বিতীয় প্রবন্ধের শেষে আলোচিত হয়েছে ‘শিল্ডজয়ের সামাজিক প্রভাব’, ‘শিল্ড বিজয়ের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য’ ও ‘শিল্ডজয় ও খেলায় বাণিজ্যিকতা’। এই তিনটে বিষয়ই আলাদা প্রবন্ধ বা বইয়ের পরিচ্ছেদ হওয়ার দাবি রাখে। বদলে এগুলোর উপর পাতাখানেক লিখেই লেখক ক্ষান্ত হয়েছেন। তৃতীয় ও চতুর্থ প্রবন্ধে যথাক্রমে হিন্দু-মুসলিম ও ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্ব টেনে আনলেন; উপলক্ষ নিশ্চয় মহমেডান ও ইস্টবেঙ্গল। এর পরের দুই প্রবন্ধ যথাক্রমে, ‘ভারতীয় ক্রিকেটদলের পাকিস্তান ‘শুভেচ্ছা’ সফর ২০০৪: ক্রিকেট, কূটনীতি ও রাজনীতি’ এবং ‘ক্রিকেট যখন রাজনীতির দোসর: সাম্প্রতিক বি সি সি আই এবং সি এ বি নির্বাচন এবং রাজনৈতিক দোলাচল’। প্রবন্ধ সংকলনের নামে এ কেমন ভণ্ডামি? লেখক নিজেই আবার ভূমিকায় খেলার ইতিহাসচর্চা নিয়ে অভিমান করেছেন তাঁর গবেষণাকে নিয়ে ‘‘এক সন্দেহের বাতাবরণ... খেলাকে ইতিহাসে নিয়ে আসার মূঢ়তা নিয়ে তাচ্ছিল্য”। প্রথমত, এ জাতীয় ঠোঁট ফোলানো বালসুলভ, অযথা সাফাই গাওয়া। তারপরে এমন এক উদ্ভট সংকলন পেশ করলে আমরা যারা তাঁর গবেষণার পৃষ্ঠপোষক, তারাই সত্যি তাচ্ছিল্য করতে বাধ্য হব।
বইয়ের পেছনের মলাটে লেখক পরিচিতিতে প্রকাশক লেখকের স্তুতি গাইবেন তা বলাই বাহুল্য। এ ক্ষেত্রে প্রশংসা পেয়েছে এই প্রবন্ধ সংকলনে লেখকের ‘সাবলীল ভাষা এবং তথ্য উপস্থাপনের মুন্সিয়ানা, ফটোগ্রাফ ও বইয়ের শেষে নির্ঘণ্ট’। প্রবন্ধগুলির বিভিন্ন জায়গায় ভাষা সাবলীল তো নয়ই, উল্টে জগাখিচুড়ি বলা চলে। একই বাক্যে অযথা তৎসম ও ইংরাজি শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। ঠোক্কর খেতে খেতে প্রবন্ধ পড়ার আনন্দটাই তাই মাটি; এত সুন্দর বিষয়টা মাঠেই মারা যায়। তারপর তথ্য উপস্থাপনা। যে কোনও ইতিহাস, তা সে খেলারই হোক বা বলিউডের, আলোচনা তথ্যনির্ভর হওয়া উচিত। তবে, তথ্যই যদি পনেরো আনা জায়গা নিয়ে নেয়, তা হলে আর ইতিহাসবিদ প্রাবন্ধিক প্রবন্ধে নিজের খেলা দেখানোর সুযোগ পাবেন কী করে? এই প্রবন্ধ ছ’টিতেই একই সমস্যা পাতার পর পাতা শুধু অন্যের মতামত কোনওটা বাংলায়, কোনওটা ইংরেজিতে, কোনওটা অনুবাদে। সবচেয়ে বিরক্তির কারণ বোধকরি ছত্রে ছত্রে পাদটীকা। গোটা বইয়ে ১১২ পাতা লেখায় ৪১১টি টীকা! গড়ে পাতাপিছু খান চারেক; কোনও কোনও পাতায় (যেমন পৃ: ৬৩) খানদশেক। সব পাদটীকা বইয়ের পেছনে। অতএব, এক পাতা পড়তে গড়ে চার পাতা উল্টে পেছনে গিয়ে আবার ফেরত আসতে হয়। টীকা যদি প্রয়োজনীয়, তবে তা মূল লেখায় কেন থাকবে না? যেমন, নগেন্দ্রপ্রসাদের পারিবারিক পরিচয় টীকা হিসেবে কেন? প্রবন্ধের বিষয়ই তো নগেন্দ্রপ্রসাদ। গ্রন্থ-তালিকার অনেকগুলি তথ্যসূত্র ছিল। তবু তালিকাটা অসম্পূর্ণ। আর লেখক রবীন্দ্রনাথকে, বিশেষত ছেলেবেলা-কে সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন।
বইয়ের ভেতর শুরুতেই মোট আটটি ছবি। এর মধ্যে শিল্ডজয়ী দলের ছবি ছাড়া কোনওটাই বলবার মতো নয়, প্রবন্ধের সঙ্গে ঠিক খাপও খায় না। ছোটবেলায় আমরা সংবাদপত্রের পাতা কেটে এর থেকে ভাল ছবি জমাতাম। ছবিগুলির ছাপা অতি নিম্নমানের। শিল্ডজয়ী দলের কোন জন কে, তা জানলে ভাল লাগত বর্তমান প্রজন্মের কেউ শিবদাস ভাদুড়ির ছবি দেখেনি ভাবলে কষ্ট হয়।
প্রথম বইটি পড়ার পরে রাগে গজগজ করতে করতেই দ্বিতীয় বইটি প্লেয়িং ফর ফ্রিডম: আ হিস্টোরিক স্পোর্টস ভিকট্রি পড়তে শুরু করি। এই বইটা আশাতীত ভাবে অজস্র প্রশংসার দাবি রাখে। একই লেখক একই বিষয়ে বিদেশি ভাষায় বেশি ভাল লিখবেন তা ভাবিনি। প্রথমত, এটার ছাপা, বাঁধাই, কাগজ শতগুণে ভাল। লেখকের ভাষা আশ্চর্যজনক ভাবে সাবলীল; ভুলভ্রান্তি, ভাষার অপব্যবহার নেই সেটা হয়তো-বা ইংরাজি প্রকাশনা বিভাগের সম্পাদনার গুণে।
এই বইটি সংকলন নয়, বই হয়েছে ঠিক যেমনটি মনে মনে চেয়েছিলাম। কিছুটা প্রথম বইয়ের অনুবাদ হলেও প্রবন্ধগুলি খাপছাড়া নয়। এখানেও ছয়টি প্রবন্ধ, তবে এগুলি ধারাবাহিক। মূলত প্রথম বইয়ের প্রথম চারটিকে ভেঙে ছয়টি পরিচ্ছেদ। সমস্যা যে এই বইতেও নেই তা নয় এখানেও পাদটীকা; ছবি নেই। প্রচ্ছদে শিল্ডজয়ী দলের ছবি যেটা প্রথম বইতে ব্যবহার হয়েছে, সেটারই রঙিন সংস্করণ। দেখতে ভাল, তবে এখানেও চরিত্র-পরিচিতি নেই।
দুটো বই পড়ে মনে হল, একশো বছর আগে এক বাঙালি দল ইংরেজদের ফুটবলে হারিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু এ যুগে সেই ঘটনার বিবরণে, একই লেখকের কলমে ইংরেজি ভাষার বই বাংলার বইকে আধ-ডজন গোলে হারাল। |
|
|
|
|
|