হুকিং-বিরোধী অভিযানকে ঘিরে বৃহস্পতিবার মগরাহাটে গোলমালের ঘটনায় ‘বিরোধী বন্ধুদের প্ররোচনা’র সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার সেই মগরাহাটে গিয়ে তৃণমূলেরই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় এবং দলের দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়কে শুনতে হল দলেরই স্থানীয় দুই নেতার ‘প্রতিশ্রুতি’ ভঙ্গের কথা। ক্ষোভ উগরে দিলেন গ্রামবাসীরা। হেনস্থার পরে ধাক্কা দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয় স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক নমিতা সাহাকে। গ্রামের বিভিন্ন দেওয়ালে দেখা যায় পুলিশ ও তৃণমূূলের বিরুদ্ধে পোস্টারও। |
শুক্রবার অবশ্য গ্রামে প্রথমে আসে সিপিএমের একটি প্রতিনিধিদল। নেতৃত্বে ছিলেন বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা, দলের জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী এবং প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁরা নিহতদের বাড়িতে যান। পরে সুজনবাবু বলেন, “আমরা রাজনীতি করতে আসিনি। বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে। সেই জন্য দলমত নির্বিশেষে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমরা ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই।” ঘটনার প্রতিবাদে আজ, শনিবার ১২ ঘণ্টা মগরাহাট-২ ব্লকে বন্ধ ডেকেছে সিপিএম। সুজনবাবুরা চলে যাওয়ার পরে সিপিএমের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ উগরে দেন স্থানীয় লোকজন। তাঁদের বক্তব্য, ক্ষমতায় থাকাকালীন সিপিএমও দীর্ঘদিন বিদ্যুদয়নের আশ্বাস দিয়ে তাঁদের বঞ্চিত করে রেখেছিল। জেলা কংগ্রেস এবং এসইউসি-র একটি প্রতিনিধিদলও নিহতদের বাড়িতে আসে।
এ দিন আলোর ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই মগরাহাটের নৈনান গ্রামে ভিড় জমে সংবাদমাধ্যমের। আসতে শুরু করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। হুকিং-বিরোধী অভিযানকে ঘিরে ওই গ্রামে একটি মাদ্রাসার মাঠে বৃহস্পতিবার জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ হয়। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় সায়েরা বিবি নামে এক বধূ এবং রেজিনা খাতুন নামে এক স্কুলছাত্রীর। জখম হন আরও কয়েক জন।
এ দিন ওই মাদ্রাসার মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে প্রচুর গুলির খোল এবং না-ফাটা গুলি। গ্রামবাসীদের অনেকের হাতে হাতেও ঘুরেছে সেই সব গুলি। যা নাইন এমএম পিস্তল ও কার্বাইনের বলে পুলিশ সূত্রের খবর। যে অস্ত্র বৃহস্পতিবার বেশ কিছু পুলিশকর্মীর হাতে দেখা গিয়েছে। গাছে, মাদ্রাসা এবং আশপাশের বাড়ির দেওয়ালেও দেখা গিয়েছে গুলির চিহ্ন। তা দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। |
ময়না-তদন্তের পরে শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতাল থেকে দু’টি দেহ গ্রামে নিয়ে যান মুকুল রায় এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়। তাঁরা ঢুকতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রামবাসীরা। কিছু গ্রামবাসী দেহ দু’টি তাঁদের পরিবারের হাতে তুলে দেন। মুকুলবাবুদের কাছে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের অভিযোগ, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে প্রচারের সময়ে তৃণমূল নেতা খয়রুল হক লস্কর এবং মহারানি পাল এই এলাকায় বিদ্যুদয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ভোটে জেতার পরে প্রথম জন মগরাহাট-২ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হয়েছেন। দ্বিতীয় জন নৈনান গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হয়েছেন। কিন্তু এখনও সব পরিবার বিদ্যুৎ পায়নি।
তৃণমূলের দুই প্রথম সারির নেতার কাছে গ্রামবাসীদের দাবি, বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার কর্মীরা যখন লাইন কাটতে এসেছিলেন, তখন কথা বলার জন্য দুই নেতানেত্রীকে বহুবার ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা আসেননি। তার পরেই গোলমাল বাধে। দুই নেতানেত্রীকে অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়ারও দাবি তোলেন গ্রামবাসীরা। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে ‘পুলিশকে উস্কানি দিয়ে গুলি চালনায় প্ররোচিত করা’ সংক্রান্ত পোস্টারও দেখা গিয়েছে এ দিন।
স্থানীয় ওই দুই নেতানেত্রীর সম্পর্কে কোনও মন্তব্য না করলেও মুকুলবাবু স্বীকার করেন, “এখানে বিদ্যুতের সমস্যা ভয়ঙ্কর। গ্রামবাসীদের দাবি যুক্তিযুক্ত। এখানে রাস্তাঘাটের উন্নয়নেরও প্রয়োজন আছে।” তিন-চার মাসের মধ্যেই ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দেন তিনি।
মুকুলবাবুর কাছে নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং অন্যান্য ব্যবস্থা কী হবে, তা জানতে চান স্থানীয় বাসিন্দারা। মুকুলবাবু সরাসরি কোনও আশ্বাস দেননি। তিনি বলেন, “নিহতদের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও এই ঘটনায় ব্যথিত। তিনি কিছু একটা ব্যবস্থা করছেন।” নিহতদের পরিবারের লোকজনের দাবি, ওই তৃণমূল নেতারা তাঁদের সঙ্গে কোনও কথাই বলেননি। বাড়িতেও আসেননি। সায়েরার স্বামী সফিকুল শেখ বলেন, “আমার সঙ্গে কোনও তৃণমূল নেতাই কোনও কথা বলেননি। তাঁরা আমাদের বাড়িতেও আসেননি।” একই ভাবে রেজিনার দিদি রোজিনা খাতুন বলেন, “আমাদের সঙ্গে তৃণমূলের কেউ কোনও যোগাযোগ করেননি।” |
বস্তুত, মুকুলবাবু বা শোভনবাবু ছাড়া এলাকায় স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের কাউকে দেখা যায়নি। যোগাযোগ করা যায়নি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বা পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে। দু’জনেরই মোবাইল বন্ধ ছিল। তাঁরা বাড়িতেও ছিলেন না। বিকালে মগরাহাট পূর্ব কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক নমিতা সাহা গ্রামে এলে তাঁকে হেনস্থা করা হয়। ধাক্কা দিয়ে তাঁকে গ্রামের বাইরে বের করে দেওয়া হয়। নমিতাদেবী বলেন, “কাল রাতে ঘটনার খোঁজ নিয়েছি। দু’জনের মৃতদেহ আনার সময়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে ছিলাম। তা সত্ত্বেও গ্রামবাসীরা আমাকে হেনস্থা করল। কেন বুঝতে পারলাম না।”
রাজনীতির লোকজনের আনাগোনা থাকলেও এ দিন গ্রামে উর্দিধারী পুলিশের দেখা মেলেনি। তবে, সাদা পোশাকে কয়েক জন পুলিশ ছিলেন। প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে কলস মোড়ে র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স এবং বাহিনী নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) কঙ্করপ্রসাদ বারুই। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় মগরাহাট থানার ওসি আশিস দাস-সহ ১৫ জন কর্তব্যরত পুলিশকে ‘ক্লোজ’ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা। তাঁদের মধ্যে তিন জন জেলা কমব্যাট ফোর্সের জওয়ান। তাঁরা কার্বাইন থেকে গুলি চালিয়েছিলেন বলে পুলিশ সূত্রের খবর। এ দিনই নিহতদের ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট জানতে পেরেছে পুলিশ। নিহতেরা গুলিতেই মারা গিয়েছে বলে সেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে বলে পুলিশ সুপার জানান। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, “বিভাগীয় তদন্ত চলছে।” তবে, বৃহস্পতিবারের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানার এ দিন ওই গ্রাম থেকে ১০০ রাউন্ডেরও বেশি গুলি ও খোল মিলেছে জানিয়ে পুলিশের দাবি, অত গুলি তারা চালায়নি। তা কোথা থেকে এল, তা তদন্ত করা হচ্ছে। |