কে সান্ত্বনা দেবে! বছর দশেকের চনমনে মেয়েটা যে এ ভাবে চলে যাবে কেউ কি তা ভাবতে পেরেছিলেন? নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করলেও কেউই তাই এগিয়ে এসে সন্তানহারা মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বৃহস্পতিবার মগরাহাটে হুকিং কাটতে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার লোকজন ও পুলিশ গেলে বাসিন্দারা বাধা দেন। তা নিয়ে সংঘর্ষ বাধে। চলে বোমা, গুলি। তারই মধ্যে পড়ে গুলিতে মারা যায় ক্লাস ফাইভের ছাত্রী রেজিনা।
এদিন বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, অঝোরে কেঁদে চলেছেন রেজিনার মা। দিদি রোজিনাও বোনের শোকে পাথর। কোনওক্রমে জিজ্ঞাসা করলাম কি ঘটেছিল?
কথাটা শুনে একবার তাকাল রোজিনা। চোখ মুছে বলল, “ওর স্কুলে কাল বিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল। রোজই পরীক্ষা দিয়ে বিকেল তিনটে নাগাদ বাড়ি ফেরে। তিনটে বেজে গেলেও না ফেরায় ভাবলাম বোধহয় বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছে। তাই দেরি হচ্ছে। এরই মধ্যে শুনি মাদ্রাসার মাঠের কাছে খুব গোলমাল হচ্ছে। স্কুল থেকে রোজ ওই রাস্তা দিয়েই বোন ফেরে। গোলমালের কথা শুনে তাই চিন্তা হল। তার উপর ৪টে বেজে গিয়েছে। তাই দেরি না করে ভাবলাম এগিয়ে দেখি। মাঠের কাছকাছি গিয়ে দেখি প্রচণ্ড গণ্ডগোল। প্রচুর ভিড়। তারই মধ্যে ফট ফট আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎই দেখি লোকজন পড়ি কি মড়ি করে দৌড়চ্ছে।” |
একটু থেমে ফের শুরু করে রোজিনা, “এ সব দেখে কিছুটা হতবাক হয়ে যাই। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই বোনের জন্য এদিক ওদিক খোঁজাখুজি শুরু করি। দেখি একটু দূরে রাস্তার ধারে একটা পরীক্ষার বোর্ড পড়ে আছে। গিয়ে দেখি তাতে প্রশ্নপত্র লাগানো। তুলে বুঝলাম সেটা বোনেরই। এরই মধ্যে চারপাশ দিয়ে লোকজন দৌড়চ্ছিল আর বলছিল পালাও পালাও।”
ফের দম নেয় রোজিনা। আবার শুরু করে, “আমি তখন পাগলের মতো বোনকে খুঁজছি। আর কোনওদিকে খেয়াল নেই। লোকজনের দৌড়াদোড়ির মধ্যে হঠাৎ দেখি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বোন। ছুটে গিয়ে মুখটা আমার দিকে ফেরাতেই দেখি গলা দিয়ে গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে।” কথা শেষ করতে পারল না রোজিনা। কেঁদে উঠল হাউ হাউ করে। ফের সামলে নিয়ে বলল, “জানো দাদা, বোনটাকে নিয়ে দু’ঘণ্টা মাঠেই বসেছিলাম। বার বার লোকজনদের বলছিলাম ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সবাই পালাতে ব্যস্ত। পুলিশ চলে যাওয়ার পরে সন্ধে সাতটা নাগাদ কয়েকজন এগিয়ে আসে। তার পরে একটি ভ্যানে বোনকে নিয়ে কলস মোড়ে যাই। সেখান থেকে অটো ধরে ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালে। সাড়ে ১১টা নাগাদ ডাক্তার আমাদের জানায় বোন বেঁচে নেই। আমাদের দিকে কিন্তু কেউই তাকায়নি দাদা।” ওকে জিজ্ঞাসা করি, মন্ত্রী যে এসেছিলেন তিনি তোমাদের কিছু ক্ষতিপূরণের কথা বলেছেন? মাথা নেড়ে রোজিনা যা জানাল, তাতে পরিষ্কার, কেউই তাদের কিছু বলেননি। দিনের আলো শেষ হয়ে এসেছে। ঘড়িতে প্রায় ৫টা। কাল যেখানে রেজিনার দেহ পড়েছিল সেই মাঠেই ম্যাটাডরটা এসে দাঁড়াল। ম্যাটাডর থেকে নামল রেজিনার নিথর দেহটা। |
রেজিনাদের বাড়ি থেকে ঢিলছোড়া দূরে সফিকুল শেখের বাড়ি। সেখান থেকেও ভেসে এল কান্নার রোল। গত রাতে গুলিতে মৃত্যু হয়েছে সফিকুলের স্ত্রী সায়েরা বিবির। সায়েরা বিবির এক আত্মীয়া জানালেন, বিকেল চারটের সময় মাঠের দিকে গণ্ডগোল বাধে। সায়েরার ছোট ছেলে বাড়িতে ছিল না। ছেলেকে খুঁজতেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ও। গণ্ডগোলে ছেলের খোঁজে এদিক ওদিক ছুটছিল। কাছেই একটি বাড়ি তৈরি হচ্ছে। ছেলেকে খুঁজতে তার উপরে উঠে যায় ও। হঠাৎই মাথায় লাগে গুলি। সেখানেই লুটিয়ে পড়ে সায়েরা। স্ত্রীকে হারিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে কী করবেন এখন সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না সফিকুল। দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন। বাকরুদ্ধ। বেশ কয়েক বার জিজ্ঞাসার পরে সাড়া দিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, মন্ত্রীরা যে এসেছিলেন, তাঁরা কী আপনাদের কোনওরকম ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন? উত্তর এল না। পেশায় দোরজি সফিকুল ছেলেময়েদের ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
গণ্ডগোলের খবর পেয়েই স্বামীর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন সফিকুলদের প্রতিবেশী ফরজানা বিবি। কী করবেন, প্রতিবন্ধী স্বামী যে ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে গেলে বিপদের শেষ থাকবে না। বৃহস্পতিবার রাতভর বাড়ি না ফেরায় আর স্থির থাকতে পারেননি ফরজানা। সকাল হতে না হতেই যাকেই সামনে পেয়েছেন শুধিয়েছেন, “আমার স্বামীকে দেখেছ?” বেলায় মন্ত্রী- নেতারা গেলে তাঁদের হাতে পায়ে ধরেছেন স্বামীকে খুঁজে দেওয়ার জন্য। বিকেলের দিকে মাঠের পাশে চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলেই ফেললেন, “পুলিশ গুলি করে মানুষটাকে মেরে বোধহয় দেহ লোপাট করে দিয়েছে।” ঘড়িতে তখন পাঁচটা। হঠাৎই হই হই আওয়াজ। একদল যুবক চিৎকার করে উঠলেন, “মাদ্রাসার পিছনের বাঁশবাগানে কার দেহ পড়ে রয়েছে।” শুনেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুট লাগালেন ফরজানা। কাছে গিয়ে জখম স্বামীকে পড়ে থাকতে দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল।
ফের কান্না ফরজানার। এতক্ষণ যা ছিল শোকের অশ্রু, স্বামীকে ফিরে পেয়ে সেটাই বদলে গেল আনন্দাশ্রুতে।
|