রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বলল, আলাদা ভাবে পুলিশকে দায়ী করা যায় না। পুলিশ সরকারেরই অধীন। আর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী সরাসরি দায়ী করলেন পুলিশকেই! বললেন, পুলিশ যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তার জন্য তিনি ‘লজ্জিত’। পুলিশমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশকে দুষল জোট সরকারের শরিকও।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে রাজ্য রাজনীতির কারবারিদের এমনই ‘বিচিত্র’ অবস্থান দেখার সুযোগ করে দিল মগরাহাট-কাণ্ড!
বিদ্যুতের হুকিং কাটতে গিয়ে গোলমালের জেরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে পুলিশের গুলিতে তিন জনের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর ‘ক্ষোভে’র কথা বৃহস্পতিবার রাতেই স্পষ্ট করে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও এক ধাপ এগিয়ে শুক্রবার তিনি বলেছেন, “এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। আমি নিজে লজ্জিত পুলিশ এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে। ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হবে। পুলিশ গুলি চালিয়ে অন্যায় করেছে। তবে এ ঘটনার পিছনে কয়েক জন সাহায্য করেছে। বোমা, গুলি নিয়ে গোলমাল বাধিয়েছে।”
পুলিশের আচরণের ‘দায়’ যে তাঁর সরকারের নয়, তা বোঝাতে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা এ কথাও বলেছেন যে, “৩৫ বছর ধরে এই পুলিশরাই কাজ করছে! আমি তো কাউকে নতুন করে নিয়োগ করিনি। সব পুলিশ খারাপ নয়। তবে কারও কারও প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এত দিন তো ট্রিগার-হ্যাপি পুলিশ হিসেবেই এরা ছিল! বন্দুক ঠিক ভাবে চালাতেও পারে না অনেকে!” বিগত বামফ্রন্ট জমানার দিকে আঙুল তুলে মুখ্যমন্ত্রীর আরও মন্তব্য, “আগের সরকারের সময় তো হাজার বার গুলি চলেছে! একটারও বিচার হয়নি!” |
হুকিং চলছেই মগরাহাটে। সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি। |
সচরাচর কোনও ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার বিরুদ্ধে সব চেয়ে আগে সরব হয় বিরোধীরা। নন্দীগ্রাম-সহ একাধিক ঘটনায় বিরোধী নেত্রী থাকার সময় মমতাও যা করে এসেছেন। কিন্তু মগরাহাটের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীই যে ভাবে পুলিশকে দায়ী করেছেন (বস্তুত, থানার ওসি-কে ইতিমধ্যেই অপসারণ এবং তিন পুলিশ কর্মীকে ‘ক্লোজ’ করা হয়েছে), তাতে বিস্মিত বিরোধী শিবিরই! নতুন সরকারের আমলে কয়েক মাসেই আসানসোল, বগুলা, মগরাহাটে (সিপিএমের দাবি, হাড়োয়াতেও) গুলি চালনার প্রেক্ষিতে তাঁরাও কি পুলিশকে ‘ট্রিগার-হ্যাপি’ মনে করছেন? আলিমুদ্দিনে এ দিন এই প্রশ্নের জবাবে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “পুলিশ ট্রিগার-হ্যাপি হয়ে গিয়েছে, নির্দিষ্ট করে এমন কথা বলতে চাই না। আসল কথা সরকার। দোষ দিতে হলে সরকারকেই দিতে হবে।”
তার অব্যবহিত আগেই বিধান ভবনে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেছেন, “যে পুলিশের জন্য নিরপরাধ এক কিশোরী ও এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারকে আবেদন করছি। এই সরকার ট্রিগার হ্যাপি পুলিশের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করতে পারে,
এটাই প্রমাণ করতে হবে।” মগরাহাটে গিয়ে বামেদের পাশাপাশিই কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদলও খোঁজখবর নেয়। তাদের রিপোর্ট পেয়েই মান্নান বলেন, “আগের সরকারের আমলে অপরাধ করেও পুলিশের শাস্তি হত না। সেই রীতি যেন এই সরকারের ক্ষেত্রেও না-হয়, তার ব্যবস্থা করতেই মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।”
খুব প্রয়োজন না-হলে গুলি চালাবে না, এই মর্মে পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে রাখা সত্ত্বেও ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে’ মগরাহাটের ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “মগরাহাটের ওসি-র তো উচিত ছিল ব্যাপারটা জেলার পুলিশ সুপারকে জানানো। পুলিশ সুপার জানাবেন ডিজি-কে। ডিজি জানলে আমায় জানাতেন। কিন্তু কেউ আমায় জানানোর প্রয়োজনই মনে করেনি! জানলে একটা ব্যবস্থা নেওয়া যেত!”
শুধু পুলিশই নয়, মুখ্যমন্ত্রী আরও কিছু পক্ষকে
মগরাহাটের ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন। বলেছেন, “বিদ্যুৎ দফতরের কেউ কেউ পুলিশকে ক্ষেপিয়ে নিয়ে এসে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।” আরও বলেছেন, “যদি কেউ বোমা ছুড়ে থাকে, তার জন্যও প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সিপিএম এখন ক্ষ্যাপা হয়ে গিয়েছে! পরিকল্পনা করে লোককে ক্ষ্যাপাচ্ছে! পুলিশ প্রশাসনকে অধৈর্য হলে চলবে না। সিপিএম এখন ক্ষমতা থেকে চলে গিয়ে যে কোনও বিষয়ে দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করছে! সব সিপিএমের সাজানো নাটক!”
বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের জেরে ‘হতচকিত’ হয়ে পড়েছে সিপিএমও! বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুর কথায়, “কাকে দায়ী করছেন, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না! পুলিশের প্রশিক্ষণ নেই বলছেন, সিপিএম ক্ষ্যাপা হয়ে গিয়েছে বলছেন। বিদ্যুৎ দফতরকে দোষ দিচ্ছেন। আবার বলছেন, ওঁর বিরোধীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ওঁর বিরোধী তো নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না! ওঁর বিরোধী মাওবাদী, এসইউসি, কংগ্রেস, এমনকী, তৃণমূলও আছে! মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ওঁর দল থেকেই ওঁর কাছে অভিযোগ যাচ্ছে। কাকে দায়ী করছেন, সেটা আগে নির্দিষ্ট করে বলুন! কার দায়িত্ব ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এত জনকে দায়ী করা হচ্ছে?” বিরোধী দলনেতার কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী যত বলেন, তত অস্পষ্টতা বাড়ে!”
গোটা ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে প্রধান বিরোধী দল। সূর্যবাবু বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি জানতেন না। ওসি, এসপি, ডিজি এবং মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে কে কাকে জানালেন না, বোঝা যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীই যদি এমন কথা বলেন, তা হলে শুধু প্রশাসনিক তদন্ত করলে হবে না। বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাই।”
একই দাবি তুলেছেন বিজেপি-র রাহুল সিংহ এবং পিডিএসের সমীর ও অনুরাধা পূততুণ্ড। প্রাক্তন বিধায়ক দেবপ্রসাদ সরকার-সহ এসইউসি-র ৫ জনের একটি দল মগরাহাটে নিহতদের পরিজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কাল, রবিবার মগরাহাটে ১২ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছে এসইউসি। সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনও দোষী পুলিশদের শাস্তি এবং বিদ্যুৎহীন গ্রামগুলিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার দাবি তুলেছে। আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, সুজন চক্রবর্তী, সুভাষ নস্কর-সহ বাম প্রতিনিধিদল মগরাহাট ঘুরে এসে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট শীর্ষ নেতৃত্বকে রিপোর্ট দিয়েছেন, বিদ্যুৎ কর্মীদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা হচ্ছিল। তাঁরা হুকিং বন্ধ রাখবেন কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে টাকা জমা-দেওয়া আবেদনকারীদের বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে দেওয়ার আর্জি গ্রামবাসীরা জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে কার নির্দেশে কেন র্যাফ এল, কেনই বা গুলি চালাতে হল, এমনকী, মাদ্রাসায় আশ্রয় নেওয়া গ্রামবাসীরাও রেহাই পেলেন না এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই বিচারবিভাগীয় তদন্ত চেয়েছে সিপিএম। বিষয়টি নিয়ে এ দিন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকেও আলোচনা হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় আজ, শনিবার প্রতিবাদ দিবস পালন করবে সিপিএম। কৃষক সভার ডাকে কাল, রবিবার রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি হবে। |