মগরাহাটের ঘটনা রাজ্য প্রশাসন কখন জানতে পেরেছিল, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবের বক্তব্যের মধ্যে ফারাক প্রকাশ্যে এল।
ঘটনার দিন, বৃহস্পতিবার রাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত তিনি মহাকরণেই ছিলেন। কিন্তু তিনি ওই ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানতেন না। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, তিনি ঘটনার খবর জেনেছেন টেলিভিশন মারফত। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী হলেও ঘটনার খবর তাঁকে ঠিক সময়ে না-জানানো নিয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ ব্যক্ত করেছিলেন মমতা। শুক্রবারও তিনি ওই বক্তব্যে অনড়।
অথচ তাঁরই প্রশাসনের স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম এ দিন মহাকরণেই বলেছেন, “মগরাহাটের ঘটনা সঙ্গে সঙ্গেই আমরা জানতে পেরেছি।” তাঁর ‘আমরা’ মানে কি মুখ্যমন্ত্রীও? এই প্রশ্নে সম্মতিসূচক ইঙ্গিত দিলেও সরাসরি কোনও উত্তর না-দিয়ে ধোঁয়াশা রেখেছেন স্বরাষ্ট্রসচিব।
ওই বিষয়ে মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। তাঁকে রাতে স্বরাষ্ট্রসচিবের মন্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি এই ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।” মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, কখন কী ভাবে মহাকরণে খবর পৌঁছেছিল এবং মগরাহাটের ওসি-র ভূমিকা কী, তা খতিয়ে দেখছেন ডিজি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রসচিবের বক্তব্যের অমিলের ঘটনায় প্রশাসনিক মহলের একাংশের মনে পড়ে যাচ্ছে বাম আমলে নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব প্রসাদরঞ্জন রায়ের সঙ্গে শাসক দল সিপিএমের ‘বিবাদে’র কথা। নন্দীগ্রাম না খেজুরি, কোন দিক থেকে আক্রমণ হচ্ছে, এই নিয়ে মহাকরণে সেই সময় স্বরাষ্ট্রসচিব প্রসাদবাবু নিয়মিত যা বলতেন, তা সিপিএমের দাবির বিরুদ্ধে যেত। লাগাতার এই ঘটনা ঘটতে থাকার পরে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রসচিবের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা হয়। যার জেরে শেষ পর্যন্ত পদ থেকে সরেই যেতে হয় প্রসাদবাবুকে। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুলনায় কম ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উচ্চ শিক্ষা দফতরে। |
|
|
মহাকরণেই ছিলাম, আগে জানলে
অন্য ভাবে সমাধান করতাম।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা
তা জানতে পেরেছিলাম।
জ্ঞানদত্ত গৌতম |
|
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, স্বরাষ্ট্রসচিবের এ দিনের বক্তব্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছেছে। তবে তা নিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই তাঁর তরফে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। এখন দেখার, প্রশাসনের দুই গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ ব্যক্তিত্বের বক্তব্যে এই ‘ব্যবধানে’র কী ‘প্রতিক্রিয়া’ হয়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে বৃহস্পতিবার ঘটনার সূত্রপাত দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ। ওই সময় বিদ্যুতের হুকিং কাটতে পুলিশ এবং বিদ্যুৎ পর্ষদের কর্তারা সেখানে যান। এই নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকায় সাড়ে ৪টে নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশের কমব্যাট ফোর্স ও র্যাফ। তার পর থেকেই গোটা এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে ইট-বোমা-গুলির লড়াই। শেষ পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে এক কিশোরী-সহ দু’জন মারা যান। আহত আরও এক জনের মৃত্যু হয় এ দিন। ঘটনায় পুলিশ, বিদ্যুৎ সংস্থার কর্মী-সহ বেশ কয়েক জন আহত হন।
মগরাহাটের ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি নিজে পুলিশমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ঘটনাটি প্রথম থেকে তাঁকে না-জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মমতা। তিনি এ দিনও বলেছেন, “আমি মহাকরণেই ছিলাম। আগে জানতে পারলে অন্য ভাবে সমাধান করতাম।” এত বড় ঘটনার খবর মুখ্যমন্ত্রীকে অনেক ‘দেরি’তে জানতে হয়েছে বলে যখন প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তখন স্বরাষ্ট্রসচিবের এ দিনের বক্তব্য গোটা বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে এ দিন মগরাহাটের ঘটনার কথা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “ওই ঘটনার ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত চলছে।” আর কি কোনও উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হবে? স্বরাষ্ট্রসচিবের জবাব, “সেটা এখনও ঠিক হয়নি।” জনতাকে সামলাতে পুলিশ কি বাড়াবাড়ি করেছে? তাঁর জবাব, “সেটা তদন্ত শেষ না-হলে বলা যাবে না।” কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তে কেন পুলিশের বাড়াবাড়ির বিষয়টি দেখা হবে? এ বারেও একই উত্তর দেন স্বরাষ্ট্রসচিব “ওই তদন্তে সবটাই দেখা হবে।” মৃত্যু কি পুলিশের গুলিতে হয়েছে? তাঁর জবাব, ‘‘সেটাও তদন্তে বোঝা যাবে।”
এর পরেই তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, মগরাহাটের ঘটনার কথা আপনি কখন জানতে পারলেন? স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, “ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তা জানতে পেরেছি।” সেই সময়টা কখন? জবাব আসে, “সময় রেকর্ড করিনি। তবে বিকালে।” খবর পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে তা জানিয়েছিলেন? জবাবে তাঁর ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ উত্তর, “দয়া করে আমাকে এই প্রশ্ন করবেন না।” তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, মুখ্যমন্ত্রী তো বলেছেন, মহাকরণে থাকলেও তিনি ঘটনার কথা জানতে পারেননি? এ বারে তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছেন, তার উপরে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না।” তবে আইনশৃঙ্খলা-জনিত কোনও ঘটনা যে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব এবং ডিজি-র মাধ্যমেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছোয়, তা জানান তিনি।
আইনশৃঙ্খলা-জনিত কোনও বড় ঘটনা ঘটলে জেলা পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনের কাছ থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মহাকরণে রাজ্য প্রশাসনের কাছে খবর চলে আসে বলে জানান স্বরাষ্ট্রসচিব। তাঁর কথায়, “এমন ধরনের ঘটনা ঘটলে নানা সূত্রে আমাদের কাছে খবর আসে। এটাই চালু নিয়ম। কালও (বৃহস্পতিবার) তেমন ভাবেই খবর এসেছিল।”
অন্যান্য দিনের মতো বৃহস্পতিবারও সারা দিন মহাকরণে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। শিল্প সংক্রান্ত মন্ত্রী-গোষ্ঠীর বৈঠক ছাড়াও আরও কয়েকটি বৈঠক করেন তিনি। হুগলিতে এ দিন জেলা প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর যে বৈঠক ছিল, তার প্রস্তুতি হিসাবে তিনি কথা বলেন মুখ্যসচিবের সঙ্গে। মুখ্যসচিবের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বৈঠক হয় স্বরাষ্ট্রসচিবের। তাঁরা দু’জনও অনেক রাত পর্যন্ত মহাকরণে ছিলেন। তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী কেন মহাকরণে থাকাকালীন ঘটনার কথা জানতে পারলেন না, সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছে। স্বরাষ্ট্রসচিবের এ দিনের বক্তব্য তাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে। |